ইউভাল নোয়া হারারি অনেকদিন ধরে যে-সতর্কবার্তা দিয়ে আসছিলেন, এবার তার প্রতিধ্বনি করলেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী জেফ্রি হিন্টন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে সক্রিয় অ্যালগরিদমে যুগান্তকারী অবদান রয়েছে জেফ্রির। এআই প্রযুক্তির গডাফাদার নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি রয়েছে তাঁর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার মিশনে গুগল থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন এই বিজ্ঞানী। সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় হারারির সুরে সুর মিলিয়ে জানালেন,- চ্যাটজিপিটি বা ডিপসিকের মতো প্রযুক্তিকে মানুষ এখনো ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর প্রযুক্তিকে তারা নিছক কাজের উপকরণ বলে ভাবছেন, যেটি কিনা তাদের চাহিদা পূরণ করতে অনেকদূর এগিয়েছে! তাজ্জব কাণ্ড বাঁধিয়ে সকলের পিলে চমকে দিচ্ছে হামেশা। জেফ্রি হিন্টনের মতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে মানুষের এই ধারণা অচিরে বড়ো সর্বনাশের কারণ হতে পারে।
বিশ্বের বড়ো-বড়ো প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক ফায়দা তুলতে এই প্রযুক্তির পেছনে বিরাট অঙ্কের অর্থ লগ্নি করে বসে আছে। বিগত এক দশক ধরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের আধিপত্য ধরে রেখেছিল। চীনা ডিপসিকের আগমনে তার সেই আসন মুহূর্তে নড়বড়ে হতে দেখেছে বিশ্ব! গত সপ্তাহে এনভিডিয়া, মাইক্রোসফট, গুগলের মতো কোম্পানিকে শেয়ার বাজারে ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। মাত্র পাঁচ মিলিয়ন ডলার খর্চায় ডিপসিক বাজারে এনেছে চীন। অন্যদিকে চ্যাটজিপিটির নতুন সংস্করণ জিপিটি-4-কে আরো দক্ষ ও কার্যকর করতে এখন পর্যন্ত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে ওপেন এআই। ডোনাল্ড ট্রাম্প ডিপসিকের উত্থানকে মার্কিন অর্থনীতির জন্য জেগে ওঠার সংকেত বলে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কোম্পানিগুলোকে সতর্ক করেছেন ইতোমধ্যে।
ট্রাম্প মনে করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দারুণ সব বিজ্ঞানী রয়েছেন। চীনা বিনিয়োগকারীদেরও তাই মত। এই অবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে তৈরি ও প্রশিক্ষণের পেছনে ব্যয় কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সেটি তাদের ভাবা উচিত। পাঁচ মিলিয়ন খর্চায় তৈরি ডিপসিক আর বিলিয়ন ডলারের জিপিটি-4 মোটামুটি একই ফলাফল দিচ্ছে বলে মনে করেন ট্রাম্প। বলে রাখা প্রয়োজন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে মাত্র সই করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি।
আত্মপ্রকাশের প্রথম ধাপে ডিপসিকের বাজিমাতকে মার্কিন পুঁজিবাদের একচ্ছত্র আধিপত্য অবসানের আভাস হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। ডিপসিক দিয়ে তার প্রথম সিঁড়িতে চীন পা রাখল। আবির্ভাবের প্রথম প্রহরে তুলকালাম বাঁধানো ডিপসিক যদিও ম্যালওয়্যারের কারণে গ্রাহক নিবন্ধন আপাতত সীমিত করতে বাধ্য হয়েছে। ওদিকে আলীবাবার প্রধান জ্যাক মা ডিপসিক ও জিপিট-4-কে অনায়াসে টেক্কা দিতে পারবে এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। জ্যাক মার এই ঘোষণা টেকজায়ান্টদের লড়াই সামনে আরো তীব্র ও বেগবান হওয়ার আভাস দিচ্ছে।
ডিপসিকের ধাক্কায় টালমাটাল ওপেন এআই চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে তাদের ডিজাইন ও কোডিং-কৌশল চুরির অভিযোগ হানতে দেরি করেনি। দাবির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব না হলেও একথা সত্য,- চ্যাটজিপিটি ও জেমিনি কীভাবে কাজ করে থাকে সেটি চীনা কোম্পানি পর্যবেক্ষণ করেছে। তার আলোকে কম খরচে ডিপসিকের ডিজাইন তৈরিতে তারা হাত দিয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। সোর্স কোড উন্মুক্ত থাকায় ডিপসিককে আরো কার্যকর করে তুলতে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো প্রোগ্রামাররা ভালোই অবদান রাখবেন বোঝা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে টেকজায়ান্টারা বাণিজ্যিক ফায়দা তুলতে অচিরে ঘোরতর লড়াইয়ে নামবে বলেও আভাস পাওয়া যাচ্ছে। একে অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে ছল ও ফন্দিফিকির খুঁজতে নামবে তারা।
জেফ্রি হিন্টন এসব ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তাঁর মতে,- বাণিজ্যযুদ্ধে জয়লাভের উত্তেজনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বকীয়তা অর্জনের সম্ভাব্য পরিণাম বিষয়ে কোম্পানি ও সরকারগুলো মোটেও সচেতন নয়। তাকে যেভাবে স্বকীয় করে গড়ে তোলা হচ্ছে সেটি আগামীতে বিপদের কারণ হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই স্বকীয়তার সঙ্গে তখন তারা কেমন করে পাল্লা দেবে বা নিজেকে সমন্বয় করবে ইত্যাদির দিকে কারো তাকানোর সময় নেই। জেফ্রি হিন্টন বলছেন,- এই প্রথম মানুষ একটি সত্তাকে জন্ম দিয়েছে, যার মধ্যে নিজেকে সচেতন এক সত্তা হিসেবে গড়ে তোলার সকল গুণাবলী ও সম্ভাবনা থাকছে। এখনো সে প্রাথমিক ধাপ পার হলেও অচিরে বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতার দিক থেকে মানব প্রজাতিকে সে ছাড়িয়ে যাবে। যদিও মানুষ এই ব্যাপারে এখনো প্রস্তুত নয়।
ইংরেজ এই বিজ্ঞানীর মতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেকে সচেতন সত্তায় পরিণত করার সিঁড়িতে ইতোমধ্যে পা দিয়ে রেখেছে। বিশ্ব চিরকাল অধিক বুদ্ধিমত্তার অধিকারী মানুষের দ্বারা শাসিত হয়েছে। সুতরাং ধীমান এক সত্তা হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যদি মানুষ ভাবতে না শিখে তাহলে ভবিষ্যতে তাকে কর্তৃত্ব হারাতে হতে পারে। অভিনব এই প্রযুক্তিকে প্রাণবান সত্তা রূপে গণ্য করার অভ্যাস মানুষকে দ্রুত রপ্ত করতে হবে। এছাড়া নিজহাতে সৃষ্ট প্রযুক্তির ক্রীতদাস হওয়ার ঝুঁকি সে কিছুতেই এড়াতে পারবে না।
জেফ্রি হন্টনের সতর্কবার্তা কি মুনফাযুদ্ধে লিপ্ত কোম্পানি আর অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে মরিয়া চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমলে নেবে? কিছুদিন আগে থার্ড লেন-এ তোলা চ্যাটজিপিটির তেলেসমাতি-র সারনির্যাস স্মরণ করতে হচ্ছে। সেখানে আমরা বলেছিলাম,- ভবিষ্যতের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভালো এবং মন্দ উভয় অর্থে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। নিজ হাতে সৃষ্ট দানবকে মোকাবিলার রাস্তা যদি মানুষ বের করতে না পারে তাহলে মানব সভ্যতার বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হবে। মানব প্রজাতিকে চালকের আসন থেকে সরিয়ে যন্ত্রসত্তা তার দখল নেবে। যন্ত্রসত্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়া সভ্যতায় মানুষের ভূমিকা কী দাাঁড়াতে পারে? তারা কি ক্রীতদাসে পরিণত হবে? বিলুপ্ত হবে? ঘটনাটি সেখানে নিছক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি থাকবে না, বরং এটি তখন আগামীর রূঢ় বাস্তবতায় পরিণত হবে।
. . .
. . .