নেটালাপ

ছায়ামানব মাহফুজ

শর্ট ইন্ট্রো : অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে দপ্তরবিহীন দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত মাহফুজ আব্দুল্লাহ ওরফে মাহফুজ আলম তাঁর সাম্প্রতিক একখানা ফেসবুক পোস্টের কারণে আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন। তাঁর ভাষায় পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তির পদধ্বনি তিনি শুনতে পাচ্ছেন। দেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি পুনরায় মাথাচাড়া দেওয়ার নেপথ্যে জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ত অনেকে মদদ দিয়ে যাচ্ছেন বলে আভাস দিয়েছেন মাহফুজ। সেইসঙ্গে সকল ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের ডাক দিতেও ভোলেননি। 

সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টে গেল পাঁচ মাসে সরকারের নানা ব্যর্থতা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন এই তরুণ। যদিও ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বের হতে তাঁরা কত কী করেছেন তার সাফাই দিয়েছেন বিস্তর। মাস্টারমাইন্ড খেতাবে ভূষিত মাহফুজ আলম কিছুদিন অন্তর ফেসবুকে এরকম যুদ্ধংদেহী স্ট্যাটাস ছাড়েন। সাময়িক হইচই হয়, তারপর সবটা থিতিয়ে আসে। দেশব্যাপী পরিচিতি লাভের পর থেকে কাণ্ডটি তিনি নিয়মিত করছেন বটে! এই অর্থে তাঁর সাম্প্রতিক এফবি পোস্ট নিয়ে আলাদা করে আলাপের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এই তো কিছুদিন আগে ভারতের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে যুদ্ধে নামার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। ভারতের গোদিমিডিয়া সেটি নিয়ে তুলকালাম করলেও মোদি সরকার ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি ডিল করেছিল তখন। আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তির ভাষা ব্যবহারে সচেতন হওয়ার বিষয়টি ড. ইউনূস সরকারকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তারা। মাহফুজের এসব বালপাকনা কাণ্ড কাজেই নতুন কোনো চমক নয়। কিছুদিন অন্তর তাঁর এসব বিবৃতির নেপথ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ইস্যু দিয়ে ইস্যু ঢাকার মতলব থাকলেও থাকতে পারে। এসব বিবেচনায় মাহফুজ আলমকে নিয়ে থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বিভিন্ন সময় যেসব আলাপ হয়েছে সেগুলো নেটালাপ-এ আমরা তুলে রাখছি

বিদায়ী ২০২৪ সনের সেপ্টেম্বর ১৫ থেকে নভেম্বর ৫ মেয়াদে তাঁকে নিয়ে তিন দফায় আলাপ হয়েছিল। পরবর্তীতে জনাব মাহফুজের ব্যাপারে গ্রুপ সদ্যসদের আগ্রহে ভাটা পড়ায় আলাপে যতি পড়ে। সময় যত গড়িয়েছে মাহফুজ একটি ফিক্সড প্যাটার্নে নিজেকে বারবার চিনিয়েছেন। একজনকে এভাবে চেনাজানার পর তার ব্যাপারে আগ্রহ থিতিয়ে আসে। মাহফুজের ক্ষেত্রে সেটি ঘটেছে মনে হয়। হাসিনা সরকারের পতন পরবর্তী যেসব ঘটনা আমরা গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার কথা মাথায় রেখে থার্ড লেন-এ তুলছি, এখন সেই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে মাহফুজ আলম সংক্রান্ত তিন দফায় সম্পন্ন নেটালাপ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। পাঠক আশা করি এই আলাপের পক্ষে-বিপক্ষে নিজের অভিমত রাখবেন।

. . .

Mahfuj Abdullah; Image Source – Google Image
আমি কে? 
আদি নেটালাপ : সেপ্টেম্বর ১৫ ও ১৬, ২০২৪

ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কুশীলব মাহফুজ আলম ইংরেজিতে লেখা ফেসবুক পোস্টে তাঁর অবস্থান আবারো পরিষ্কার করার চেষ্টা করলেন। মাহফুজের ইংরেজি পোস্ট সেলিম রেজা নিউটন সহজ তর্জমায় তাঁর টাইমলাইন থেকে শেয়ার দিয়েছেন। নিউটনের টাইমলাইনে পাওয়া ভাষান্তর (বানানবিধি অক্ষত রেখে) নিচে পেশ করছি। এই ব্যপারে থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বোধহয় আমরা আলাপ করতে পারি। জাতির বৃহত্তর অংশের কাছে মাহফুজের মতো হাসিনাপতনের কাণ্ডারিরা এখনো দেশগড়ার নতুন স্থপতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন, সুতরাং তাঁদের মানসগঠন আমলে নেওয়া প্রয়োজন।

মাহফুজ আব্দুল্লাহর ফেসবুক বয়ানের বাংলা ভাষান্তর 
(ঋণস্বীকার : সেলিম রেজা নিউটনের ফেসবুক থেকে শেয়ার করা ভাষান্তর)


১. ফেসবুকে আমার অন্য কোনো পেজ বা আইডি নেই, শুধুমাত্র এই আইডিটাই আমার। এই আইডি এখন ভেরিফায়েড। ভুয়া আইডি ও পেজগুলো আপনারা রিপোর্ট করতে পারেন, আনফ্রেন্ড করতে পারেন, এবং আনফলো করতে পারেন।

২. আমার বিরুদ্ধে একটি অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া এবং আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা সেলে, যে আমি ইসলামী বা উগ্রপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম, বিশেষ করে হিযবুত তাহরীরের সাথে। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা! আমি কখনো হিযবুত তাহরীরের সাথে জড়িত ছিলাম না। ইকোনমিক টাইমস-এর এক সাংবাদিক আমার হিযবুত তাহরীরের সাথে মিথ্যা সম্পৃক্ততা নিয়ে লিখেছেন, যা ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে ভারতীয় রাষ্ট্রের ন্যারেটিভে ফাঁসানোর জন্য করা হয়েছে। আমি আগে যেমন, এখনও তেমন হিযবুত তাহরীরের মতাদর্শের বিরুদ্ধে এবং যেকোনো অগণতান্ত্রিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই আছি।

৩. আমি ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাথেও জড়িত ছিলাম না। আমি তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করি নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে তারা আমাকে তাদের প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মতাদর্শ আমাকে আকৃষ্ট করতে পারে নি।

আমি জামায়াতের 'ইসলাম' অনুসরণ করি নি এবং এখনও করি না। সেই কারণে আমি তামিরুল মিল্লাত বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য শিবিরকর্মীদের মতো কোনো 'সুবিধা' বা 'অধিকার' পাই নি। বরং আমাকে ক্যাম্পাসে ইসলামোফোবিয়া এবং শিবির ট্যাগিংয়ের শিকার হতে হয়েছে।

আমাকে বেছে নিতে হয়েছে নির্জন পথ - মুজিববাদ, ইসলামোফোবিয়া এবং ইসলামী মতাদর্শের বিরুদ্ধে, বাঙালি মুসলমানদের ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষার অভিমুখে। পরে আমি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক অধ্যয়ন চক্রের সাথে জড়িত হয়ে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে আমার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা গ্রহণ করি।
Dr. Yunus introduced Mahfuz Alam as Mastermind on CGI Platform; Source – ARM_production YTC
৪. আমি ‘মাস্টারমাইন্ড' ছিলাম না। তবে নয় দফাসহ ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আমার সাথে পরামর্শ করে এবং আমার 'অনুমোদন'ক্রমে। গত পাঁচ বছরে প্রায় সব প্রোগ্রাম ও ন্যারেটিভ আমার হাত দিয়েই লেখা হয়েছে। সবই আপনার জানতে পারবেন যদি আমি বা আমার সঙ্গীরা বর্তমানের চ্যালেঞ্জগুলো পার করতে পারি। দোয়া করবেন যেন আমরা সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারি অথবা শহীদ হতে পারি। 

৫. আমি একজন বিশ্বাসী এবং বাঙালি মুসলমান। আমি ইসলামী বা সেক্যুলার কোনো মতাদর্শকেই সমর্থন করি না। আমি এই অঞ্চলে সভ্যতাগতভাবে পরিবর্তিত একটি রাষ্ট্র ও সমাজের রূপকল্প পোষণ করি, যা গড়ে উঠবে দায় ও দরদের আদর্শের ভিত্তিতে। নির্যাতিত জনগণের ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষাগুলো রাষ্ট্রনীতিতে রূপান্তরিত হবে। ঢাকা হবে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের সভ্যতাগত মেলবন্ধন এবং বেণী লেনাদেনার কেন্দ্র। ইনশাআল্লাহ!

৬. আমি ইসলামী বা অন্য কোনো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশের বিরোধী নই। আমি মনে করি রাষ্ট্রগঠনে সম্প্রদায়গুলোর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশসমূহের সহাবস্থান করার সুযোগ থাকা দরকার। রাষ্ট্রের সেক্যুলার প্রকল্প যেন কোনো সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশের জায়গাকে সংকুচিত করে না ফেলে। তবে এই অভিপ্রকাশগুলো যেন আবার ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের দিকে না যায়।

৭. একদম ঠিক ঠিক করে বললে, আমি লালন বা মার্কসের অনুসারী নই, তাই আমি ফরহাদ মজহারের ইসলাম ও মার্কসবাদ গ্রহণ করি না। লালনকে আমি বাংলার আত্ম-অন্বেষণ চর্চা ও আচার-অনুষ্ঠানের একটি সমন্বিত প্রকাশ হিসেবে দেখি। আর, যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে ততদিন প্রাসঙ্গিক থাকবেন মার্কস। তবে, বাঙালি মুসলমানদের প্রশ্নটি প্রধানত নদীমাতৃক ইসলাম ও বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের ফ্রেমওয়ার্কে আলোচনা করা উচিত। বাঙালি মুসলমানদের উচিত হীনমন্যতার শেকল ভেঙে ফেলে তাদের পূর্বপুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বদরবারে ব্যাখ্যা করা।
Mahfuj Alam’s Statement on Majar Vandalism; Image Source – @thirdlanespace.com
৮. আমি মাজার/কবর পূজারী নই। আমি বিভিন্ন তরিকার সুফি এবং আলেমদের শ্রদ্ধা করি। কৈশোরকাল এবং পরবর্তী সময়ে আমি অনেক আলেম ও পীরদের সাথে সংযুক্ত ছিলাম। এবং এখনও তাদের সাথে আমার সম্পর্ক আছে। তারা আমাকে নবীর (সা.) প্রতি ভালোবাসায় অভিষিক্ত করেছেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আবার, আমি আপোষকামী এবং ফ্যাসিবাদ সমর্থনকারী সুফিবাদ পছন্দ করি না। আমি সেই সুফি ও আলেমদের ভালোবাসি, যারা নিজেদের অধিকারের জন্য দাঁড়ান। আমি মনে করি, যারা মাজার ভাঙছে তারা আসলে বাঙালি মুসলমানদের সাধারণ আকাঙ্ক্ষা এবং বাংলার ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কাজ করছে। 

৯. ঐতিহাসিক সম্প্রদায় হিসেবে বাঙালি মুসলমানদের জোট গঠন করতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার মজলুম হিন্দু, বৌদ্ধ, ও মুসলমানের সাথে। এভাবেই দূর করতে হবে মুজিববাদ, ইসলাম-আতঙ্ক, হিন্দুত্ববাদ, এবং ফ্যাসিবাদ-সমর্থনকারী সুফিবাদ ও ইসলামিজমকে। আমরা অনেক বার দেখেছি কীভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী ইসলামিজমও মুজিববাদ ও হিন্দুত্ববাদের বাঁচার উপায় হয়ে উঠেছে।

১০. আমি আমার বাঙালি মুসলমান পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করি, যারা ত্যাগ ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে একটি সম্প্রদায় গড়ে তুলেছিলেন। এই সম্প্রদায় এ অঞ্চলে তাদের ন্যায্য হিস্যা পাবে এবং তাদের রূপকল্প বাস্তবায়িত হবে। আমি পশ্চাদপদ জাতীয়তাবাদগুলোর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের ভেতরে এবং বাইরে আরও আরও মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য দরকার নতুন ভাষা ও শব্দভাণ্ডার।

পুনশ্চ: আমার লেখাগুলোতে কেউ আহত হলে, আমি অন্তর থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি আপনাদের সকলকে সহনাগরিক হিসেবে এবং ভাই ও বোন হিসেবে ভালোবাসি। দয়াল দরদি নবিজিকে সালাম!

. . .

মাহফুজ আলম সম্পর্কে এখন পর্যন্ত তথ্য খুব একটা সুলভ না। তিনি যা জানাচ্ছেন সেটা একমাত্র সম্বল। আমার কাছে আশ্চর্যের যে, তার সহযোদ্ধাবৃন্দ অথবা যেসব সার্কেলে তিনি বিচরণ করেছেন, তারা এখনো তার ব্যাপারে নীরব;- হয়তো সময় হলে মুখ খুলবেন। যাইহোক ফেসবুকে তার দু-একটা স্ট্যাটাস, জুলাই গণপরিসরে রাখা বক্তব্য আর বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য আপাতত সম্বল। সেখান থেকে জানা যায় মাহফুজ জন্মেছেন লক্ষ্মীপুরের এক অজপাড়াগাঁয়। চাঁদপুরের একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে ভর্তি হন তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায়। সেখান থেকে আলিম পাশ করেন। বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। উইকি থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে তা‘মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা বাংলাদেশের অন্যতম ধর্মীয় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসাটি দেশের সকল মাদ্রাসার মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তারা ভালো ফলাফল করে থাকে। প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ভর্তি পরীক্ষার মেধা তালিকার প্রথম দশে স্থান পায় এই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।এছাড়াও দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে ভালো ফলাফল করে এই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন :

ড. খলিলুর রহমান আল মাদানী, সভাপতি, মসজিদ মিশন 
ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেন, বিশিষ্ট আইনজীবী
ড. আব্দুস সালাম আজাদ, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশেষজ্ঞ
ড. আবুল কালাম আজাদ, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশেষজ্ঞ
এ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ও সেক্রেটারি শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন
সালাউদ্দিন আইয়ুবি, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
হাফেজ রাশেদুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
আলাউদ্দিন আবির, সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ
Institution from where Mahfuz Alam learned about Islam; Image Source – Tamirul Millat Kamil Madrasah website

তা‘মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা ইসলামি জ্ঞানে সুপণ্ডিত ও ইসলামি জীবনাদর্শে নিবেদিত মানুষ গড়ার কাজে দীর্ঘদিন থেকে ভূমিকা পালন করছে। ছাত্রশিবিরের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরিবেশের প্রভাব এক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা জরুরি। মাহফুজ আলমের দেওয়া তথ্যমতে তা‘মীরুল মিল্লাতে ছাত্র থাকা অবস্থায় শিবিরের আহবান তিনি উপেক্ষা করেছেন, এবং নিবিড় থেকেছেন পড়াশুনায়। পরবর্তী সময়ে ২০১৫-১৬ সেশনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। বৃহৎ পরিবেশে পড়াশুনার সুযোগ ঘটে তার। আমার ধারণা এই সময়কালে তিনি বিভিন্ন ধরনের পাঠচক্রে যুক্ত হতে থাকেন। ফরহাদ মজহার, মোহাম্মদ আজমের মতো বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে আসেন। যা তার ভাবনার জগতকে সুগঠিত করতে অবদান রাখে।

এখন প্রশ্ন হলো মাহফুজের চিন্তাজগতের উপাদানগুলো কী? প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরি এ-কারণে যে, তিনি এখন আর তাত্ত্বিক জায়গায় নেই বরং প্রায়োগিক অবস্থানে আছেন। তার সাম্প্রতিক ফেসবুক স্ট্যাটাসের দিকে তাকালে বোঝা যায় নিজের ব্যাপারে তিনি ক্লারিফিকেশন দিচ্ছেন সেখানে। নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে দেওয়া বক্তব্যটি যদিও আমার কাছে আবছায়া মনে হয়েছে। সেখানে তাকে কিছুটা ধরা গেলেও পুরোপুরি বোঝার উপায় রাখেননি মাহফুজ।

উনার এই বক্তব্যকে মান্যতা দিলে তার আকাঙক্ষার জায়গাগুলো আমরা কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারব। মাহফুজের ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ফরহাদ মজহারের প্রভাব ছাড়াও আরো দুজনকে সেখানে দেখতে পাচ্ছি। একজন হলেন আহমদ ছফা এবং দ্বিতীয়জন মাওলানা ভাসানী। বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধগ্রন্থে ছফা যে হীনমন্য বাঙালি মুসলমানকে উপস্থাপন করেছেন,- মুসলমান সম্প্রদায়কে মাহফুজ সেখান থেকে টেনে বের করতে চাইছেন। স্বতন্ত্র পরিচয়ে বিশ্বদরবারে তাদেরকে হাজির করার আকাঙ্ক্ষা ধরতে অসুবিধা হচ্ছে না। আর ভাসানীর তৃণমূল রাজনীতি ও অধিকারের লড়াই তার মনে গভীর ছাপ রেখেছে। লড়াইটি জারি রাখতে প্রচলিত জাতীয়তাবাদ কিছুটা হলেও বাধ সাধে। মাহফুজ যে-কারণে সচেতনভাবে বিএনপির রাজনীতিকে নিজ চিন্তাবলয় থেকে দূরে রাখতে আগ্রহী। আওয়ামী লীগ, মুজিববাদ ইত্যাদির কোনো স্থান তার রাষ্ট্রচিন্তায় নেই। নিভৃত পরিসরে বসে মাহফুজ এভাবে নিজের প্রস্তুতির পালা সেরেছেন। বিনয় করে নিজেকে মাস্টারমাইন্ড না বললেও জুলাই আন্দোলনের নেপথ্যে নিজের প্রচণ্ড ক্রিয়াশীলতার কথা মনে করাতে ভোলেননি। তিনি এখন ব্যর্থ হতে পারেন অথবা সফল, যাই হোন-না-কেন, তার নাম ভবিষ্যতে ঘুরেফিরে আসতে বাধ্য।

এখন প্রশ্ন হলো প্রচলিত যে-রাজনৈতিক কাঠামোয় দাঁড়িয়ে তিনি স্বপ্ন দেখছেন, সেটি তার আকাঙ্ক্ষার পক্ষে কতটা অনুকূল? সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্রগঠন উগ্রবাদকে আত্মীকরণ করবে কি? করলে কীভাবে করবে? জামায়াতসহ উগ্র রাজনৈতিক শক্তির একচেটিয়া দৌরাত্মের পেছনে তার কোনো দায় কি নেই? সেকুলারিজম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে তার অবস্থান কী? প্রশ্ন অনেক! উত্তর এখনো অজানা! সময়ে হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা পাবো। পরিষ্কার হবে সবটা।

Mahfuz Alam made his speech on July Gonoporisor Seminar; Source – MSI Khan YTC

. . .

মাহফুজ একসময় সলিমুল্লাহ খানের পাঠচক্রে অন্যতম সদস্য ছি‌লেন। কাটাব‌নের কনকর্ড এম্পো‌রিয়ামে কাক নামে একটা ঘর ছি‌ল। নুসরাত নামে একজন এটার প‌রিচালক ছি‌লেন, যেখা‌নে স‌লিমুল্লাহ খান গংয়ের পাঠচক্র সপ্তাহে ৩‌ দিন বিকাল ৫টা থেকে অনু‌ষ্ঠিত হতো। আমরা পার্শ্ববর্তী নগর নামক একটা বইয়ের দোকা‌নে বসতাম। আমার ম‌নে আছে এই মাহফুজ প্রতিদিন দুপুর ২টায় এসে ব‌সে থাক‌ত। ঘটনাটি আমি ভুলে গিয়ে‌ছিলাম। আজ পিয়াস ম‌জিদের সঙ্গে কথা বলার সময় মাহফুজের প্রসঙ্গ ওঠে। পিয়াস ভাই মনে ক‌রি‌য়ে দি‌লেন। স‌লিমুল্লাহ খা‌নের প্রভাব তার ওপর কতটা কাজ কর‌ছে সেটা এখন বুঝতে পারছি না। সে কি তার ম‌তো করে নতুন কোনো থিয়োরি আবিস্কার করেছে? কিছু ধরতে পারছি না!
. . .

ধন্যবাদ জাভেদ। আপনার বক্তব্য থেকে মাহফুজের আজকের মাহফুজ হয়ে ওঠার চিত্র খানিক পাওয়া গেল। তাঁর এফবি স্ট্যাটমেন্ট ব্যবচ্ছেদ করে যেসব অনুমান আপনি করেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন, তার সঙ্গে সহমত জানাই। আমার খটকা অন্য জায়গায় :

মাহফুজকে কেন ফিরে-ফিরে নিজের ব্যাপারে বক্তব্য দিতে হচ্ছে? ফেবু পোস্টে অতীতে যেসব আলাপ তিনি তুলেছেন, হাসিনাপতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত জুলাই গণপরিসর-এ যে-বক্তব্য রেখেছেন, তার মধ্যে তো আমি (ভুল হতে পারে) মোটা দাগে আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার, মোহাম্মদ আজম, সলিমুল্লাহ খান প্রমুখের চিন্তন পদ্ধতির প্রতিধ্বনি ছাড়া আলাদা কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তিনি কি আদৌ নতুন কিছু বলছেন সেখানে? নতুন যদি বলেন সেটি ওই ইনক্লুসিভ বা অংশীজন শব্দটিকে আমরা ধরতে পারি। মজহারকে পারতপক্ষে শব্দটি প্রয়োগ করতে দেখেছি বলে মনে পড়েছে না। মাহফুজ ব্যবহার করেছেন। তাঁর চিন্তনপদ্ধতির সঙ্গে মজহারের ফারাক হয়তো এখানে। সরাসরি ইসলাম নয় তবে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের কথা তিনি তুলছেন, যারা তাদের পাওনা আজো বুঝে পায়নি। একটি দেশ জন্ম দেওয়া সত্ত্বেও পায়নি। তারা যেন সেটি পায় এই হচ্ছে তাঁর বাসনা। ইসলামের ব্যানারে পেতে হবে এমন নয় তবে ইসলামকে বাদ দিয়েও হবে না বলে তিনি মানছেন। তো এখানে মজহারের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য আমি ধরতে পারছি না।

হতে পারে হিযবুত, জামায়াত ইত্যাদির সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না। হতে পারে, তাদের সঙ্গে তাঁর ওঠবস ছিল, কিন্তু সচেতনভাবে পরিহার করেছেন। ভালো কথা, প্রশ্ন হলো,- ‘হকপন্থী’ আসলে কারা? কোনো একটি সম্প্রদায়? নাকি সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তা? তার হকপন্থী তো আমার বুঝে আসেনি! গায়েবি লাগছে শব্দটি!

মোদ্দা কথা, সরকারে বসার পর ধর্মীয় উগ্রতাসহ বিচিত্র যে-অরাজকতা দেশে চলছে, এর চাপে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন দেখে নিজের অবস্থান ক্লিয়ার করছেন মাহফুজ। উত্তর আধুনিক পন্থায় চিন্তা করা খুব ভালো একটি তরিকা হলেও পন্থাটি নানান কারণে বিপজ্জনক। আপনি কখনো নিজেকে ক্লিয়ার করতে পারবেন না। মাহফুজ স্বয়ং যেসব পাঠচক্র ও বুদ্ধিজীবী মহলে ওঠবস করেছেন এতদিন… তারা সকলে কমবেশি এখানে অভিন্ন। আপনি শুনবেন, সম্মোহন বোধ করবেন, মুগ্ধতা তৈরি হবে, কিন্তু তারা ঠিক কী বোঝাতে চাইলেন বা কী তাদের অভিপ্রায়,- সেটি কখনো পরিষ্কার হবে না।

কথাটি হয়েতা রূঢ় শোনাবে কানে,- তারা এমন এক পরিধিতে সমাজবিপ্লব চাইছেন যেখানে বিপ্লবের কোনো শর্ত আজো পূরণ হয়নি। কোনোটাই পরিণত অবস্থায় পৌঁছানোর মওকা পায়নি। না ঘটেছে বিজ্ঞানের বিকাশ, না হয়েছে শিল্পবিপ্লব, না সমাধা হয়েছে দার্শনিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে বিরাট কোনো ভাববিপ্লব। ফরহাদ মজহার তবু জোড়াতালি দিয়ে ভাবআন্দোলনের রূপরেখা খাড়া করেছেন। মাহফুজ কোনটা খাড়া করবেন, আমার বুঝে আসছে না। কারণ তিনি এর কোনোটিতে সরাসরি সম্পৃক্ত না বলে জানাচ্ছেন। যে-কারণে তাঁর হকপন্থী শব্দটি দুর্বোধ্য ঠেকছে!

Farhad Mazhar; Image Source – @thirdlanespace.com

মাহফুজের ব্যাপারে কথাটি বলা সঠিক হচ্ছে কিনা জানি না হাসান। যদি ভুল হয় পরে নিজেকে শুধরে নিতে দ্বিধা থাকবে না। মাহফুজ জ্ঞানপিপাসু। জানাবোঝার আগ্রহ যেমন আছে, নিজস্ব তরিকায় ভাবতে চেষ্টা করেন। তবে এখন অবধি তিনি এমন কিছু বলেননি যা নতুন। আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান, মোহাম্মদ আজম থেকে শুরু করে বৈদেশি চিন্তকের নির্যাস শোষণ করে তাঁর মনের একটি বনেদ তৈরি হয়েছে কেবল। মাদ্রাসা শিক্ষার ফলে যে-ইসলামি এলেম তিনি রপ্ত করেছেন, সেখানে অনেক ঝাপসা ব্যাপার তো থাকছেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঠচক্র তাকে সেই ঝাপসা বিষয়গুলোর সঙ্গে ফয়সালা করতে সাহায্য করেছে।

তিনি কিন্তু মাদ্রাসাশিক্ষার সুবাদে আগে থেকে নাস্তিক, সেকুলার, সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শকে খারিজ করে বসে আছেন। সেগুলো তার মনের অনুমোদন পায়নি। যে-কারণে এই টাইপের বুদ্ধিজীবী ও পাঠচক্র তার কাছে গুরুত্ব রাখেনি কখনো। তার দরকার ছিল এমন একটি পরিবেশ যেটি অস্তিকতা, ইসলাম, মুসলমান ইত্যাদির সঙ্গে রাষ্ট্র গঠনে বাঙালি মুসলমানের সম্ভাবনাকে মিলিয়ে দিতে পারে। ফরহাদ মজহার সেখানেই তাকে বড়ো সাহায্যটি করেছেন। সুতরাং ওই যে বলছেন, তাঁদের থেকে তিনি নিয়েছেন কিন্তু চিন্তনপদ্ধতির সঙ্গে সহবত নেই;- আমার কাছে এটি ডাহা মিথ্যা মনে হচ্ছে। ক্ষমতায় বসে পলিটিক্স কী করে করতে হবে সেটি এখন তিনি শিখছেন। সুতরাং এসব তাকে বলতে হতোই। অন্যদিকে অস্বীকার করা ভালো। এতে করে তার নিজস্ব বীক্ষণ ও ভাবনা হয়তো ভবিষ্যতে আমরা পেতেও পারি। তবে এখন পর্যন্ত তিনি উনাদের কপিক্যাট।
. . .

মিনহাজ ভাই, আমি আপনার কথার সঙ্গে একমত। মাহফুজ খুব সচেতনভাবে অন্যদের ভাবনা থেকে পৃথক দেখানোর চেষ্টা করলেও মূলগত দিক থেকে নিজেকে এখনো আলাদা করতে পারেননি। যেমন ইসলামি ভাবাদর্শের প্রশ্ন তার পিছু ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে মাহফুজ যেসব প্রশ্ন নিয়ে ডিল করছেন তাকে মজহারের কাছে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। আর ভাসানী যেহেতু মাঠ পর্যায়ে জরুরি, সুতরাং তাঁকেও রাখতে হচ্ছে।
. . .

মজহারও তাই জাভেদ। উনার সমন্বয়বাদ খেয়াল করেন। কারা আছেন সেখানে? মার্কস-লেলিন রয়েছেন, কারণ পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া কীভাবে সমাজে শ্রেণিকাঠামোকে ব্যবহার ও লালন করে সেটি বুঝতে তাঁদের বিকল্প আজো নেই। শ্রীচৈতন্য-লালন আছেন, কারণ এই দুজনকে বাদ দিয়ে বাংলার প্রান্তিকজনের সাংস্কৃতিক ভাবমানস আপনি ধরতে পারবেন না। উচ্চবর্গের চাপিয়ে দেওয়া ন্যারেটিভকে যদি ভাঙতে হয় এই দুজনকে আপনার লাগছে।

মজহার যেহেতু বাংলার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ইসলামকে ছাড়তে পারবেন না, সেখানে ইসলামি ধারায় যত ভাবাদর্শ আছে তার সবটাই কমবেশি তাঁকে রাখতে হচ্ছে। শরিয়ত থাকছে, তার সাথে মারিফতও রাখতে হচ্ছে। শরিয়তি ফতোয়াকে যে-কারণে তিনি চমৎকারভাবে মতামত বলছেন। দলিল মানে তার কাছে মতামত, যেটি হয়তো ইসলামে স্বীকৃত ইজমা ও কায়েসের মধ্য দিয়ে নিষ্পন্ন হবে, কিন্তু সেটি শেষাবধি মতামত। এর বাইরে মতামত থাকতে পারে, যেমন মজহার তাঁর নিজেরটা রাখছেন। রাজনীতির প্রশ্নে তিনি মুজিবকে খারিজ করে কাকে রাখছেন? হ্যাঁ রাখছেন ভাসানী ও জিয়াউর রহমানকে। যেহেতু এই দুজন তিনি যে-জাতি-রাষ্ট্র গঠন করতে চান, এর সঙ্গে মানায়। সব মিলেঝুলে মাহফুজ তো মজহারকে কপচান কমবেশি। এখনো নতুন কিছু কি পাচ্ছি তার ভাবনায়?
. . .

মাহফুজ আলম এর স্ট্যাটাস নিয়ে সুমন রহমান এর বক্তব্য 
(ঋণস্বীকার : সুমন রহমানের ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত)

. . .
মাহফুজ আবদুল্লাহ হিযবুত তাহরীর নন, ছাত্র শিবির নন, "মাস্টারমাইন্ড" নন, ইসলামিস্ট নন আবার সেকুলারিস্টও নন, লালন-মার্ক্স-মজহার ফলোয়ার নন, মাজার-পূজারী নন আবার মাজার-খাদকও নন। আরো কি কি যেন নন, তার স্ট্যাটাসে বিস্তারিত আছে।

নেগেশনের লম্বা তালিকা দেইখা এডোর্নোর (দেরিদা লিখেছিলাম আগে, তিনি মূলত এটাকে ক্রিটিক করেছেন যেটা পরে উল্লেখ করছি)"নেগেটিভ ডায়ালেকটিস" বইয়ের এই কথাগুলো মনে পড়ল: "The more relentlessly thought criticizes the conditions under which it lives, and the more unsparingly it tears down those definitions of being imposed by tradition, the more it is pushed, by the force of its own logic, toward that which, precisely, was supposed to be avoided: universality."

দেরিদা তার আলাপে বলছেন, বিশেষ বিশেষ অবস্থাগুলোকে ক্রিটিক বা রিজেক্ট করার মাধ্যমে সেই ক্রিটিক একসময় একটা প্যারডক্সিক্যাল টোটালিটি অনুমান করতে শুরু করে। সেইটাই বিপদের জায়গা। মাহফুজের চিন্তার মধ্যেও সেই বিপদের লক্ষণ দেখতে পাই।

তিনি জানাইছেন, তিনি আস্তিক এবং বাঙালি মুসলমান। তিনি দায় ও দরদের ভিত্তিতে সিভিলাইজেশনালি ট্রান্সফর্মড রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন। তার বিশ্বাস ঢাকা শহর এই বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক মিলনের কেন্দ্রবিন্দু হবে একদিন। অর্থাত্‌ দেরিদার ভাষায়, বিপজ্জনক ইউনিভার্সালিটি।

যাই হোক, তিনি যাদের রিজেক্ট করার মাধ্যমে দায় ও দরদভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিশন নিছেন, তাদের অনেকের মধ্যেই সেসব চিন্তার সূত্র ছিল। মাহফুজ আকাশ থেকে পড়েন নাই। আউটরাইট নেগেশন কোনো ক্রিটিকের কাজ নয়। রাজনীতিকেরও নয়। আমি কেন হিযবত তাহরীর, শিবির, মার্ক্স, সেকুলার কিংবা ফরহাদ মজহার করি না, সেই বিবৃতি আরেকটু ব্যাখ্যাও আশা করে। প্রতিটা পজিশনকে ডিফার এবং ডেফার করতে পারতে হবে। নইলে জিনিসটাকে ইগোর উদযাপনের মতই লাগবে।

. . .
Jacques Derrida; Image Credit – Paul Hoi; Image Source – milestonesjournal.net

প্যারাডক্সিক্যাল টোটালিটি

মাহফুজের সমস্যার জায়গাটি ধরিযে দিতে সুমন রহমান তাঁর পোস্টে দেরিদাকে কোট করে কিছু কথা বলছেন। প্যারাডক্সিক্যাল টোটালিটিকে টার্ম হিসেবে ইউজ করছেন সুমন। অর্থাৎ জাতি, রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে সক্রিয় নানারকম ন্যারেটিভ নিয়া আপনার মনে প্রশ্ন বা আপত্তি আছে। এগুলাকে সন্দেহ ও ক্রিটিকের চোখ দিয়া আপনি দেখতেছেন। কোনোটাই সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারতেছেন না। যার ফলে আপনার ভিতরে প্যারাডক্স জন্ম নিতেছে। দার্শনিকের দ্বিধা ও ধাঁধায় আপনি নিমজ্জিত।

এখন এর থেকে বাহির হওয়া কঠিন। আর সেখান থেকে আপনার মনে প্যারাডক্সিক্যাল টোটালিটি কাজ করতে আরম্ভ করবে। দ্বিধাগুলা হইতেছে এক একটা মশলা। আপনি তখন সবগুলা কড়াইতে দিয়া কিছু একটা পাক করার চেষ্টা করবেন। মাহফুজ, এবং তার যারা প্রেরণা, তারা সকলে কমবেশি সেই কাজটা করতেছেন। সুমন কতকক্ষেত্রে রান্নাটা টেস্টি বইলা মত দেন, কতক ক্ষেত্রে স্বাদ ভালো না বইলা রিজেক্ট করেন। উনি বা আমরা সকলে কমবেশি এই উত্তর আধুনিক রন্ধন পদ্ধতির শিকার।

এই পর্যন্ত সই, বিপদ হইল, মশলাগুলা দিয়া আপনি যদি এমন কিছু পাক করার খোয়াব দেখেন, যেইটা সকলে টেস্টি মানবে বইলা ধারণা করতেছেন, সেখান থেকে বিপদ শুরু হইতে পারে। বিড়ম্বনাও। মাহফুজের ঢাকা ও বেঙ্গল বেসিন কেন্দ্রিক জাতি, রাষ্ট্র, সংস্কৃতির মিলনবিন্দু রচনার স্বপ্ন বা এই রাজনীতিকে সুমন বিপজ্জনক ইউনিভার্সিলিটি বইলা চিহ্নিত করতেছেন। কারণ দিন শেষে এইটা নিজে তখন ওই আওয়ামী বা মোল্লা ধাঁচের একরৈখিক ন্যারেটিভ জন্ম দিতে পারে। কাজেই, সুমন তার পোস্টে মাহফুজের প্রব্লেম ভালোই ধরতে পারছেন। সেলিম রেজা নিউটন অবশ্য এখনো ধরার অবস্থায় নাই। বিপ্লব ভক্তির নেশা না কাটা পর্যন্ত ধরতে পারবেনও না। নেশা যদি কাটেও দ্রুত হাক মাওলা বইলা ক্ষতিকর অন্য কোনো নেশার ছিলিম টানার সম্ভাবনা তাঁর ক্ষেত্রে থাকতেছে।
. . .

সেকুলার ও রিলিজিয়াস নিয়া তালগোল 
আদি আলাপ : অক্টোবর ০৭, ২০২৪ 

মাহফুজ আলম নিয়ে লিখেছেন তুহিন খান। মূলত মাহফুজের ওপর বহুমাত্রিক আক্রমণ রোধ করার চেষ্টা থেকে। এই লেখায় মাহফুজের সংঘপাঠের বিষয়টি উঠে এসেছে। ইতিপূর্বে তার চিন্তায় প্রভাববিস্তারী উপাদান নিয়ে যে- আলোকপাত আমরা করেছি সেই প্রেক্ষাপট এখানে কিছুটা পরিষ্কার হলো। মাহফুজ নিয়ে আগ্রহ পড়তির দিকে। তবু সরকারে তরুণদের প্রতিনিধি হিসেবে তার একটা অবস্থান রয়েছে। এটা ঠিক যে, ইসলামি কাঠামোয় তার অবস্থান ও বিচরণ, তথাপি উগ্র ইসলামকে প্রতিরোধে তার চিন্তা (বাস্তবে এর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান হওয়া সত্ত্বেও) ও কর্মকৌশল খারিজ করতে ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনো রাজি নই;- আরো কিছুদিন দেখতে আগ্রহী।
. . .

সেক্যুলার ইজ রিলিজিয়াস, রিলিজিয়াস ইজ সেক্যুলার;- এই ভাবরে কাজে লাগায়ে সেক্যুলার-রিলিজিয়াসের পরিসরগত বাইনারিকে ডিকন্সট্রাক্ট ও রিকন্সট্রাক্ট করতে চান উনি। তুহিন খানের কথাটার অর্থ কিছু বুঝলাম না জাভেদ! মাথার ওপর দিয়া গেল মনে হইতেছে!
. . .

মিনহাজ ভাই, উনাদের চিন্তার ধরনটা ওইরকম বোধহয়। উগ্র ইসলাম অনুসারী জামায়াত-হেফাজত তাকে নাস্তিক্যবাদী ট্যাগ দিয়া দিছে। মুক্তচিন্তাযর জায়গা থেকেও মাহফুজ আলম সন্দেহজনক চরিত্র। আনন্দবাজার হিজবুত তাহরীর বলে ছাপ্পা মারছে পিঠে। বহুমুখী আক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় সমন্বয়বাদ। ফরহাদ মজহারের পাঠশালায় গমন করতে অভ্যস্ত তুহিন খান সেই পথে মাহফুজকে উভয় পক্ষের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর চেষ্টায় সমন্বয়বাদের তত্ত্ব হাজির করছেন।
. . .

Farhad Mazhar Interview on Majar Vandalism; Source – The Daily Campus YTC

সেক্যুলার ইজ রিলিজিয়াস, রিলিজিয়াস ইজ সেক্যুলার বইলা ত্যানা প্যাঁচানোর দরকার ছিল না জাভেদ। ফরহাদ মজহারের পাঠশালার লোক যদি হয়ে থাকেন তাইলে বলব, মজহারকে উনি ধরতে ব্যর্থ হইছেন। সব বাদ দেন, মাজার ভাঙার পর মজহারের মোস্ট ভাইরাল সাক্ষাৎকার ইয়াদ করেন একবার। সেখানে উনি পরিষ্কার বলছিলেন, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না, ব্যক্তির থাকে। সেকুলার বোঝার জন্য তাঁর কথাটি গুরুত্ব রাখে।

ব্যক্তি যদি রিলিজিয়াস হয় তাইলে তার পক্ষে সেকুলার হওয়া সম্ভব নয়, এখানে ইমান-আকিদার বিষয় আছে। অন্যদিকে সে যদি সেকুলার বইলা নিজেকে ভাবে তাইলে ওইটা হবে তার ভ্রান্তি। ধর্মে সে অবিশ্বাসী হইতে পারে; অজ্ঞেয়বাদী হইতে পারে,- কিন্তু সেকুলার না। তার মানে একটা-না-একটা পক্ষ ছাড়া ব্যক্তির কোনো অবস্থান বাস্তবে আসলে থাকে না।

এখন আসেন সেকেন্ড পয়েন্টে, ব্যক্তি যখন রাষ্ট্র গঠনে শরিক হয় তখন সে একখানা বিমূর্ত জিনিসকে মূর্ত করার কাজে নামে। সে আর ব্যক্তি থাকে না! রুশোর সামাজিক চুক্তির অধীনস্থ সত্তায় রূপান্তরিত হয়। সমাজ তাকে চুক্তি করে সকলের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্বটা দিয়া দেয়। সে এখন ইলেক্টেড এন্ড সিলেক্টেড এনটিটি। যতক্ষণ সে রাষ্ট্রে ততক্ষণ তার অবস্থান ব্যক্তির মধ্যে নাই। সমাজ তাকে রাষ্ট্রযন্ত্রে ফিট করে রাখতেছে। কাজেই নিজের ব্যক্তিগত অভিপ্রায় তারে বিস্মৃত হইতে হবে। বিষয়টি খেয়াল রাখা খুব জরুরি।

এখন সেই সমাজে বিচিত্র ধর্ম বিশ্বাসের মানুষ আছেন। অবিশ্বাসী, অজ্ঞেয়… উনারা সব গায়ে গায়ে লেগে থাকেন। সকলের যৌথ চাওয়া-পাওয়া তারে নিশ্চিত করতে হইতেছে। এমতাবস্থায় কোনো একটা দিকে ঝুঁকে পড়ার সুযোগ নাই। তো এই জায়গা থেকে রাষ্ট্র নামক যন্ত্র বা তার সকল উপাদানকে এমনভাবে গড়তে হবে যেন সকলের পারপাস সে সার্ভ করতে পারে। কাজেই রাষ্ট্রকে আমরা সেকুলার বইলা ঘোষণা দিতে বাধ্য হই

তার মানে কি এই,- ড. ইউনূসের মতো এই রাষ্ট্রখানা অবাধে মাজার ভাঙতে দিবে? দেখেও দেখবে না? অথবা মোদির মতো মুসলমানের ধর্মীয় আচার পালনে প্রতিবন্ধকতা খাড়া করবে? হাসিনার মতো তসলিমাকে দেশে আসতে দিবে না? মোটেও না। রাষ্ট্রের কাজ হবে সকলের বিশ্বাস ও আচার পালন এবং মত প্রকাশের সুযোগ নিশ্চিত করা। এগুলা যেন বিনষ্ট না হয় তার দেখভাল রাষ্ট্রের এখতিয়ারে পড়তেছে। তথাপি… তথাপি… একটার প্রতিও তার কোনো পক্ষপাত থাকতে পারবে না। যান্ত্রিক এই অবস্থটা হইতেছে সেকুলার। এর সঙ্গে তুহিন খানদের অর্গানিক সেকুলারের সাযুজ্য নাই।

এই সেকুলার আদতে আইনি বিষয়। আইন এমনভাবে তৈরি থাকবে যেন সেগুলা সকল মত-পথের সুরক্ষা পক্ষপাতহীন নিশ্চিত করতে পারে। আবার তাদের মধ্যে কেউ উগ্রতার পরিচয় রাখলে তারে দমন করতেও পারে। এই টাইপের সেকুলার রাষ্ট্র নানা ত্রুটি সত্ত্বেও মানবগ্রহে কার্যকর নাই এমন নয়। ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও অনেক দেশে আছে। সে রিলিজিয়াস না, সে হইতেছে এমন ঈশ্বর যার কাজ সকলের সুরক্ষা।

তুহিন খান এখানে ব্যক্তির বাইরে গিয়া রাষ্ট্রকে ভাবতে পারতেছেন না। ক্ষমতা ও রাষ্ট্র এমন এক বায়বীয় সত্তা যারে ব্যক্তি অপারেট করে, আবার বায়বীয় সত্তাটারে অপারেট করতে গিয়া সে নিজে এগুলার দ্বারা পরিচালিত হইতে থাকে। যে-কারণে ব্যক্তির অবস্থান থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা ভাবতে না পারলে, সেভাবে সবকিছু সাজাইতে না পারলে কোনো ফল মিলে না। উনি বা মাহফুজ আদতে ইসলামকে ডিল করতে গিয়া সব ভজকট করে ফেলতেছেন। না পারতেছেন গিলতে, না পারতেছেন উগরাইতে। এভাবে তালগোল গোলতাল করতে-করতে দেখবেন সব থিয়োরি বুড়িগঙ্গায় ভেসে সেলিম রেজা নিউটনের বাটিতে হাজির হইছে। উনি একমাত্র থাকবে, যাকে উনারা এগুলা গিলাইতে পারবে।

model of the secular state; Image Source – iStockphoto: Thinkstock

তুহিন খান এক জায়গায় লিখছেন,– এই আন্দোলনের মূল চিন্তা বা আকাঙ্ক্ষার একটা জনমালিকানা ও গণশরিকানা ছিল। আন্দোলন সফল হওয়ার পেছনেও এই সেন্টারহীনতার ভূমিকা ছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর আমরা দেখলাম যে, একদিকে আন্দোলনের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ও বর্গরে নানা কায়দায় ‘আদার’ করা শুরু হইল।

বিসমিল্লায় গলদ করে বসে আছেন তুহিন। জুলাই আন্দোলনে ‘আদার’ গোড়া থেকে সক্রিয় ছিল। হাসিনার মতো জবরদস্ত একখান আয়রন লেডিকে নামানোর জন্য শিবির, ছাত্রদল, হিযবুত থেকে আরম্ভ করে সকল পলিটিক্যাল স্টেকহোল্ডার তুহিনদের ছাতার নিচে সমবেত হইছিল তখন। জান দিয়া ফাইট দিতে তারা কোনো ঘাটতি রাখে নাই। দেশ জুড়ে তাণ্ডব, খুন-খারাবি আর লাশ ফালানোর মধ্য দিয়া আন্দোলনের হাইপ তারাই উঠাইছিল দেশে। এখন হাসিনা ফিনিশ হওয়ার পর নিজের ক্রেডিট তো দাবি করবেই। তারা কি আপনাদের মতো গাধা,- দরদ, অংশীজন, জনমালিকানা, গণশরিকানার মতো শব্দ নিয়া পড়ে থাকবে? প্রত্যেকের নিজস্ব এজেন্ডা ছিল। হাসিনাকে নামানোর খাতিরে কেবল আপনাদের গেঞ্জির ভিত্রে ঢুকে পল রবসনের উই আর ইন দ্য সেইম বোট ব্রাদার আওরাইছে বেদম। কাজ শেষ, এখন তারা নিজের ভাগ বুঝে নিতে চাইবে… এইটা স্বাভাবিক।

তারা ভাই ক্ষমতায় যাইতে চায়। ক্ষমতাকে অপারেট করতে চায়। কীভাবে করতে হবে সেইটা তাদের নিজ মোতাবেক সেট করা আছে। এখন তারা কী কারণে আপনাদের সঙ্গে তাল দিতে যাবে? দিতো, যদি আপনারা তাদেরকে ডিল করতে পারতেন। সেইটা কি করছেন? শুরুতে ড. ইউনূসকে নিয়া আসলেন? নিয়া আসার সময় রাজনৈতিক দলগুলার সঙ্গে বসার ঠেকা বোধ করেন নাই। জামায়াতের সঙ্গে মিলে ভাইভাই হইলেন আপনারা। বাকিরা হয়ে গেল দুধভাত! দরদ, অংশীজনের শর্ত খোদ আপনারাই ভঙ্গ করছেন প্রথম!

এতই যদি গণশরিকানায় বিপ্লব করার শখ ছিল তাইলে নিজেরা কেন পলিটিক্যাল এন্টিটি রূপে প্রকাশিত হওয়ার চিন্তা করেন নাই তখন? ফরহাদ মজহারের ইশকুল আর ঢাবি ক্যাম্পাসে বসে তো বিস্তর পাঠচক্র করছেন! কেন একটা রাজনৈতিক শক্তি রূপে নিজেদের ভাবেন নাই? দল তৈরি করেন নাই? করেন নাই ভালো কথা, হাসিনা নামার পর রাজনৈতিক শক্তিগুলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে করণীয় সেটল করতে সমস্যা ছিল কি? তখন তো তাদের গোনায় ধরেন নাই আপনারা! মজহার কিন্তু বিষয়টা আঁচ করে সবার সঙ্গে বসার কথা বলছিলেন। ড. আসিফ নজরুলকে সকল দায়িত্ব দিয়া আপনারা তখন কোন তাওয়ায় রুটি সেঁক দিতেছিলেন? আর গণশরিকানা, জনমালিকানা… এগুলা হইছে, মাল মুহিতের শব্দ ধার করে বলি,- রাবিশ টক। আন্দোলনে মিডল ক্লাসের হুজুগেরা ছাড়া বাকিদের সম্পৃক্ততা কতটা কি ছিল সেইটা প্রশ্নসাপেক্ষ।

ফিডব্যাক ব্যান্ডের মাকসুদ তো এক হপ্তা যাইতে-না-যাইতে প্রশ্নটা উঠাইছিলেন, কত পার্সেন্ট লোক এখানে শরিক? বাংলা ব্যান্ড গানের পাগলারে আপনে তখন খুব ঝাড়ছিলেন। শুইনা রাখেন ভাই, মাকসুদরা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ফসল। মাকসুদ তার গানে রাষ্ট্রকে যেভাবে খুল্লামখুল্লা ক্রিটিক করছে, আপনাদের আন্দোলনে ওই আওয়াজ উডা নামের Rap গানটা ছাড়া বড়ো হাইপ তোলার মতো গান পয়দা হয়নি। একিন না হইলে মাকসুদের ওইসময়কার গানগুলা শুনে আসেন একবার। এখনো সমান প্রাসঙ্গিক।

Parowardigar by Maqsood; Source – Maqsood O’ Dhaka YTC
মাহফুজ নিয়া তালগোল : ড. জেকিল এন্ড মি. হাইড 
আদি আলাপ : নভেম্বর ০৫, ২০২৪

জাতির সক্রেটিস মাহফুজ আলমকে হিযবুতি প্রমাণের নিউজ নিয়া কবিলেখক মহলে বেহুদা হাউকাউয়ের কোনো মানে খুঁজে পাইতেছি না। মাহফুজ হিযবুত হয়ে থাকলে এখন আর কিছু যায় আসে না। হিযবুত না হইলেও ঘটনা সমান থাকতেছে। বাংলাদেশে হিযবুত, শিবির, খিলাফত, ইসলামি হুকুমত ইত্যাদি হইতেছে চব্বিশের অকাট্য বাস্তবতা। দুইহাজার ঊনিশ সালে গ্রেপ্তার হিযবুতি মাহফুজ আর চব্বিশের মেটিকৌলাসলি প্ল্যানড আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড মাহফুজে ভেদাভেদ নাই। দুজনের ডেস্টিনি এক। যে যার পথে উনারা ইসলামদরদি সমাজরাষ্ট্র কায়েমে অবদান রাখতেছেন।

আমাদের কবিলেখকরা বড়ো নাদান! বড়ো অবুঝ! মায়ের কোলে বসে দুধু খাইতেছেন এক-একজন! প্রোফাইল আবেগের বশে লালে লাল করতে উনাদের মিনিট লাগে না। ধোঁকা খেয়ে বোকা বনতেও সেকেন্ড পার হয় না। উনারা হাওয়ার মানুষ। হাওয়া খান। হাওয়ায় ভেসে কবতে মারান। মাহফুজদের মেটিকৌলাসলি প্ল্যানড মগজের মহাসূক্ষ্ম নিউরন কোন লাইনে চলে সেইটা টের পাবেন কী করে! নিজেকে প্রথম শিবির দাগানো শবনম ফারিয়া, লাল বিপ্লবী বাঁধন ম্যামদের সঙ্গে কবিলেখকদের ফারাক করা যাইতেছে না! তাতে অবশ্য অবাক যাওয়ার কিছু নাই। বাংলাদেশে সাহিত্যিক সূক্ষ্মতার পতন ঘটছে।
. . .

Taste the feeling. All this pain is an illusion.

জাভেদ, জাতির নতুন সক্রেটিস নিয়া আমার আগ্রহ বিশেষ অবশিষ্ট নাই। নকলি মালকে আসল ভাইবা বেশিদিন খাওয়া যায় না। থু করে ফেলে দিতে হয়। মোজো সাময়িক পান করতে পারেন, কিছুদিন বাদে কোকাকোলা খাইতে হবে আপনাকে। Taste the feeling;- শ্লোগানটা কোক একসময় বাজারে নিয়া আসছিল। জনপ্রিয় হইছিল ব্যাপক। চিহ্ন বিশ্লেষণে পারঙ্গম রলাঁ বার্থ ওইসময় জীবিত থাকলে, আমি নিশ্চিত, শ্লোগানটা নিয়া ফাটাইয়া লিখতেন দুলাইন। কোক এইটা মিন করছিলেন তখন,- জীবনে ফিলটাই আসল, বাকিটা ভুয়া। ফিল আছে তো টেস্ট আছে, ফিল নাই তো কুছ নাই। কাজেই অন্য পানীয়র কাছে যতই যান আপনে, আবেগের বশে বিবেক হারাইয়া যান, আপনাকে কোকে ফেরত আসতে হবে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এখন ওয়াইন ও কোমল পানীয় পছন্দ করে না বইলা প্রেস মিটে এসে স্পন্সর কোকের বোতল সরিয়ে রাখতে পারে। রোনালদো কোকের বোতল কিক আউট করে দেখে আপনি সাময়িক কোক পান বন্ধ রাখতে পারবেন, কয়েক ঘণ্টায় শেয়ার বাজারে বিলিয়ন ডলার লস খাবে কোক, দিন শেষে কিন্তু ফিল পাইবেন না। কোকাকোলায় ফিরতে হবে আপনার!

ফিলিস্তিন দরদকে পুঁজি করে মোজো ফিলিস্তিনের পতাকা বোতলে সেঁটে ভালো টাকা কামাইতেছেন। মোজো এখন বিড়ি আকিজের বিগ ভ্যাঞ্চার। কোকের মার্কেট ভ্যালু প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ নেমে গেছে। অনেক চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র করলেও পতন ঠেকাইতে পারে নাই। কিন্তু ওই যে ফিল! ওইটা তো শত বছরের পুরানা! হাসিনাপতনের উত্তেজনায় ফিলিস্তিন নিয়া পাবলিকের দরদে ভাটা পড়ল। মোজো মার্কেটে থাকলেন, কিন্তু খেয়াল করছেন কিনা জানি না, কোক ছুপা রুস্তমের মতো ধীরে-ধীরে ফেরার তাল শুরু করছে। কারণ আছে, মোজোর মধ্যে ইদানীং গুমসা একখান গন্ধ পাইবেন। গন্ধটা আগেও ছিল। ফিলিস্তিনি দরদে আমরা সেইটা নাকে ফিল করতে পারি নাই।

প্রাণ-এর প্ল্যান্ট ব্যবহার করে কোক-পেপসি দুই কোম্পানি বাংলাদেশে পানীয় উৎপাদন করে। সতেরো হাজার কোটি টাকার মার্কেট তারা দখলে রাখছিল। মার্কেটের দখল নিতে মোজো তখন প্রাণের কাছে প্ল্যান্ট ভাড়া নিতে চাইছে। কোক কুটনামি করায় নিতে পারে নাই। পরে তো শুনলাম চাহিদা সামাল দিতে জার্মানি থেকে মেশিন আনছে তারা। ওদিকে হাসিনাপতনের ঝড়ে প্রাণের কারখানা নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হইছে। প্রাণ-আরএফএল-এর মালিক তো সুন্নি না। সম্ভবত এই কারণে অ্যাটাকড হইছিলেন তারা। রিকভারি করছে মনে হয়।

Parabola (Official Video) by Tool Band; Source – Tool Band YTC

যাই হোক, কোকাকোলা আজ-নয়-কাল কামব্যাক করবে। গ্লোবাল প্লেয়ারকে আপনে লম্বা সময় মাঠের বাইরে রাখতে পারবেন না। ব্যাক করবেই তারা। তার মানে অর্ণবের কোক স্টুডিও বাংলাও ফিরতে পারে আবার। ইমেজ মোরমত করতে অন্য রূপে হয়তো ফিরবে। এসব বলার একটাই কারণ,- মাহফুজ হইতেছেন মোজো। লোকাল প্লেয়ার। উনাকে অফসেট করে ডগিম্যানরা সামনে আসতেছে। ডগিম্যান কারা? সেইটা ধরতে চাইলে ইংরেজ অল্টারনেটিভ রক ব্যান্ড টুল-এর বডিহরর ধাঁচে বোনা প্যারাবোলা গানটা শুনতে পারেন। বহুত পুরানা ব্যান্ড। দুর্দান্ত একখানা লাইন তারা ডেলিভারি দিছিল গানে : We are eternal, All this pain is an illusion. সত্যিই তাই। সকল ব্যথাই আসলে বিভ্রম। ভৌতিক দেহখান হয়তো চিরন্তন, যে খালি ব্যথা সইতে থাকে আর সইতে থাকে…। দেহটারে ঘিরে যত ত্রাস যত সন্ত্রাস…, সব রিপিট হয় বারবার। তার মধ্যে আমরা বেঁচে থাকার মওকা খুঁজি। শ্বাস লইতে চাই। মাহফুজের এখনতরি ওইটা টের পাইতে দেরি আছে, তবে পাইবেন এইটা নিশ্চিত।

ব্যথা এখনো টের পায় নাই উনি। যখন পাইবে নিজ দেহটারে ভৌতিক বোধ হবে। দেখবে, পেছনটা কারা জানি রক্তাক্ত করে দিছে। বেঁচে থাকাটারে তখন, টুল ব্যান্ডের শব্দ ধার করে বলি,- হোলি গিফট ভাবাটা কঠিন মনে হবে। সাইকেডেলিক রক হইলেও টুল কিন্তু প্রচণ্ড স্পিরিচুয়াল। দুর্দান্ত গিটার রিফের সঙ্গে গানের কথায় মিনিংফুল। বিগ প্লেয়ার জীবন ও দেহটারে নিয়া কতভাবে তামাশা করে সেইটা জানত বইলা গানের কথায় নির্বেদের আভাস নিয়া আসছিল তারা। আমাদের এখানে তাহসান ও জন কবির এই ফিলটা বাংলাদেশে আনতে চাইছিল একসময়। তাহসান পরে পথ চেঞ্জ করছে। জন কবির ইন্দালো নিয়া সেই পথে এখনো সরব। জন কবিরের আন্তঃনগর গানখানায় টুল ব্যান্ডের দেশি ফিল পাওয়া যায় খানিক। অশ্লীল আগুনে পোকারা পুড়ছি/ অন্ধকার লাশ ঘরে কার যুদ্ধ লড়ছি?/ এই অন্ধ-বধির শহরে/ কে যাবে আগে, কে পরে? জন কবির, আমার বিবেচনায়, ওয়ান অব দ্য মোস্ট আন্ডাররেটেড মিউজিশিয়ান ইন বাংলা অল্টারনেটিভ রক।

মাঠে বিগ প্লেয়াররা নামার টাইমে বাকিরা আসলে ফুটনোটে রূপ নিতে থাকে। মেসি-রোনালদো যদি মাঠে নামে তখন কী অন্য কারো দিকে তাকাইতে মন চাইবে? চাইবে না। এ-কারণে তারা GOAT। কাজেই মোজো ছেড়ে Taste the feeling পান করার সময় মনে হইতেছে আমাদের জন্য বেশি দূরে নাই।
. . .

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 4

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *