বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় লোকজনের চোখে তরুণ ভাবুকের তকমায় ভূষিত আসিফ মাহতাব উৎসর সঙ্গে আলাপচারিতার একখানা পডকাস্ট থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শেয়ার দিছিলাম মাস দুই আগে। হাসিনা সরকারের আমলে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে হিজড়া জনগোষ্ঠীর দেহমনে সক্রিয় রূপান্তরকামী জটিলতার সঙ্গে বাচ্চাদের পরিচয় করানোর মতলবে শরীফ-শরীফার গল্প সংযুক্ত করা হয়। এখন এই গল্পের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নিয়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দানে নিয়োজিত আসিফ তুলকালামের একশেষ করে ছাড়ছিলেন। ঘটনার জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে তাৎক্ষণিক অপসারণ করে। হারুন আঙ্কেলের ভাতের হোটেলেও মনে হয় যাইতে হইছিল তাঁকে। ফিলিস্তিন ইস্যুত দেশে কোকোকোলা বয়কটের ধুম চলতেছে তখন। অসিফের অপসারণে ক্ষুব্ধ মোল্লাসমাজ ব্র্যাক পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বিকাশকে বয়কটের ডাক দিয়া বসে তাৎক্ষণিক। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল আর সুশীল সমাজের চাপ সরকারের ওপর তীব্র হইতে থাকে। তীব্রতা প্রশমনে গল্পখানা প্রথমে পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হইলেও পরে পাঠ্যপুস্তক থেকে অপসারিত করা হয়।
হিজড়া কোনো ব্যক্তির মধ্যে রূপান্তরকামী আকাঙ্ক্ষা কী কারণে জাগ্রত হয়, হাদিস-কোরান-ফিকাহয় গমন করলেও কেন সেইটা অবৈধ হইতে পারে না ইত্যাদি নিয়া একদল যুক্তি হাজির করছিলেন, কিন্তু হাসিনা সরকারের ওপর খাপ্পা ও ইমানি জজবায় শহিদ হইতে রাজি নেটিজেনদের কাছে সেগুলা পাত্তা পায়নি। শরীফ-শরীফার গল্পে যদিও রূপান্তকামী বাসনা এই পর্যায়ের ছিল না, যা এখন বিশ্ব জুড়ে নারী সমকাম, পুরুষ সমকাম, উভকাম, রূপান্তরকামী ও যৌনবাসনা রহিতদেরকে একসঙ্গে প্যাকেটবন্দি করা LGBTQ মুভমেন্টে আমরা দৃশ্যমান দেখতে পাই। নারীর এখন পুরুষ, পুরুষের নারী, নারী ও পুরুষ উভয়ের যন্ত্রমানব অথবা যন্ত্রমানবকে মানবীয় অূনভূতি (Transhuman) দিয়া বিনির্মাণের বাসনা নিয়া ইউরোপ-আম্রিকায় অজস্র ন্যারেটিভ প্রতিনিয়ত জন্ম নিতেছে। পক্ষে-বিপক্ষে এসব নিয়া বিতর্কের অন্ত নাই। অনেকের ধারণা, এর মধ্য দিয়া মানুষ তার নিজেকে অপশনাল বা ঐচ্ছিক করে তুলতেছে। এখন থেকে যদি প্রতিরোধ করা না যায় তাহলে মানব প্রজাতির ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বেই পড়বে। আসিফ মাহতাব, ধারণা করি, ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার প্রতি অনুরাগ আর পাশ্চাত্য বিশ্বে জোরদার বিতর্কের প্রভাবে শরীফ-শরীফার গল্পের ওপর প্রচণ্ড খাপ্পা ছিলেন।
গল্পখানা অবশ্য ভাষাগত কিছু সমস্যা বাদ দিলে খাপ্পা হওয়ার মতো গুরুতর ছিল না। গল্পের লেখক সেরকম মতলবে এটি লেখেন নাই। বিদেশ যাপনের কারণে হবে হয়তো, ধার্মিক হওয়ার কারণে হইতে পারে, শরীফ-শরীফার গল্পকে পশ্চিমা দেশগুলোয় চলতে থাকা বয়ান বাংলাদেশে আমদানির মতলব ঠাউরে আসিফ মাহতাব এক সেমিনারে গল্পটি নিয়া তুলকালাম ঘটান। এই সুবাদে তাঁর পিঠে দার্শনিকের ছাপ্পা বসানো হয়। আসিফ মাহতাব যদিও ঠিক কী কী দার্শনিক প্রস্তাবনা নিয়া এ-পর্যন্ত কাজ করছেন, একাডেমিক জার্নালে কিছু পাবলিশ করছেন কিনা, ফিলোসফিক্যাল স্কুলিং কোনটা ইত্যাদির কিছুই জাতির কাছে পরিষ্কার ছিল না। এখনো কেউ তা জানে বইলা মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, এইটা মানতে হবে, তাঁর মধ্যে দার্শনিক জায়গা হইতে প্রশ্ন উঠানোর আগ্রহ ও উক্ত বিষয়ে আলাপে গমনের সক্ষমতা মন্দ না।
যত যাই বলি, জাতি-রাষ্ট্র-সমাজ গড়তে দার্শনিক ভিত্তির প্রয়োজন ফেলনা নয়। ভিত্তিটা কেমন হবে ইত্যাদি নিয়া পরিষ্কার ফয়সালায় উপনীত হওয়া উচিত। রাজনৈতিক দলভেদে ফয়সালা ভিন্ন হইতে পারে। হওয়া স্বাভাবিক। সকল দল মিলে মৌলিক কিছু বিষয়ে ঐক্যমত্যে উপনীত হওয়া তাই জরুরি। বাংলাদেশে আজোবধি যারা মসনদে গেছেন তাদের মধ্যে এসব নিয়া ভাবনা কখনো সবল ছিল না। আওয়ামীদের পিঠে মুজিববাদের ছাপ্পা থাকলেও এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাদেরকে কখনো সরব হইতে দেখা যায় না। মুজিববাদ বলতে তারা বাহাত্তরের চার মূলনীতিকে বোঝে। এখন এর দার্শনিক ভিত্তি নিয়া লীগের পূর্ণাঙ্গ কোনো পেপারওয়ার্ক আছে বইলা মনে হয় না। হাসিনা আমলে বিরোধীশিবির অবিরাম এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়া প্রচারণায় মত্ত থেকেছে। ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খানের মতো প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীরা মুজিববাদকে সমানে তুলোধুনা করে গেছেন। আশ্চর্য এই-যে, অভিযোগ খণ্ডনে আওয়ামী লীগকে কখনো সরব হইতে দেখা যায় নাই! বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি চর্চায় দলটির অন্তঃসারশূন্যতাকে যা প্রকট করে সেখানে।
মুজিববাদ-এ ভর দিয়া কীভাবে তারা জাতিরাষ্ট্র গড়তে চায় তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দল বা দলপন্থী বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে জাতির সামনে পেশ করার দায় যেন আওয়ামী লীগের কখনোই ছিল না। এর থেকে বেশ বোঝা যায়, আওয়ামীরা বাহাত্তরের সংবিধানে সন্নিবেশিত চার মূলনীতি রক্ষার কথা হামেশা উচ্চারণ করলেও এগুলাকে এখন মুজিববাদ নামক কোনো ভাবাদর্শে গহিন করার ভাবনায় তারা যাইতে পারে নাই। বিএনপিসহ বাকি দলগুলার অবস্থাও তথৈবচ। দল হিসেবে তাদের হয়তো একখান করে আদর্শিক ভিত্তি আছে। এর ওপর ভর দিয়া তারা রাজনীতি করে, কিন্তু জাতিরাষ্ট্র গঠনে উক্ত ভিত্তির সুদূরপ্রসারী দার্শনিক প্রস্তাবনার অনুশীলন কারো মধ্যেই সবল নয়। ক্ষমতায় বসে লুটপাট করতে পারলেই কেল্লা ফতে ভাবে তারা। জামায়াতে ইসলামি এদিক দিয়া ব্যতিক্রম। মওদুদীর ভাবনা ও প্রস্তাবনাকে দলের আদর্শিক ভিত বইলা তারা মানে। এর দার্শনিক রূপরেখা যেন জাতির কাছে পৌঁছানো যায় সেই লক্ষ্যে আসিফ মাহতাবের মতো তরুণদের তারা ব্যবহার করতেছে।
এই জায়গা থেকে মনে হইল, অধুনা বিশ্ব একসময় মোটা দাগে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিভক্ত ছিল। সেই অনুপাতে নিজেদের একখান ভাবাদর্শ তারা গড়ে নিছে। সমাজতন্ত্রের ঐতিহাসিক পতন ঘটলেও চীন, রাশিয়া বা লাতিন আমেরিকার একাধিক রাষ্ট্রকে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত বলা যাবে না। পুঁজিবাদের নানাবিধ উপাদানকে আত্মীকরণ করলেও রাষ্ট্র পরিচালনার ধাঁচে সমাজতান্ত্রিক আদলকে নির্বাসনে পাঠানোর অবস্থায় তারা এখনো পা দেয় নাই। মিশ্র অর্থনীতির বলয়ে এর ছাঁচখানা রেখে দিছে। জাতিরাষ্ট্র গঠনের মামলাও আপাতত সেই ছকে সক্রিয় আছে। এসবের নেপথ্যে থিংক ট্যাংক হিসেবে রাষ্ট্রচিন্তকরা নিজ ভূমিকা নিভাইতেছেন সেখানে।
পুতিনশাসিত রাশিয়ার কথাই ধরি। পরাশক্তি হিসেবে সে আসলে কী চায়, কোনখানে যাইতে চায়, কীভাবে দেশবাসীকে একটা কাঠামোয় রাখতে চায় ইত্যাদি সকলের কাছে বোধগম্য করে তুলতে আমরা পুতিনকে সক্রিয় দেখতেছি। নেপথ্যে যিনি বা যারা আছেন তারা পুতিনের পরামর্শক হিসেবে ভূমিকা রাখতেছেন। ভলাদিমির পুতিনের সমুদয় কাণ্ডকারখানার নেপথ্যে সচল দার্শনিক ভিতের প্রণেতা হিসেবে আমরা যেমন আলেকজান্ডার ডুগিনকে পাইতেছি সেখানে। ডুগিনের ব্যাপারে যদি তল্লাসি করি তাহলে বুঝতে পারব কেন বা কী কারণে আসিফ মাহতাব দার্শনিক ভিত গঠনের আলাপ সামনে নিয়া আসছেন। সময়ের সঙ্গে যা নতুন আঙ্গিকে মোড় নিতে পারে, কিন্তু জাতিরাষ্ট্র গঠনে এর প্রয়োজন আছে বৈকি!
সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়াকে পুনর্গঠনে নিয়োজিত ভলাদিমির পুতিনের মতো একনায়ককে দার্শনিক রসদ সরবরাহে আলেকজান্ডার ডুগিনের ভূমিকায় বিস্তারিত হওয়ার আগে বলা প্রয়োজন,- ডুগিন রাশিয়াকে তার চিরাচরিত ক্যাথলিক ঐতিহ্যে ফেরত নিতে ইচ্ছুক। রাশিয়া কোনো বস্তুবাদী রাষ্ট্র হবে না, যেমন সোভিয়েত জামানায় ছিল। এই রাষ্ট্র হবে হাজারবর্ষ ধরে তার দেহে সক্রিয় মরমি ও আধ্যাত্মিক খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে স্থিত ঐতিহ্যে ফেরত যাওয়ার উপায়। সেইসঙ্গে সোভিয়েত পতনের সুবাদে তার বৃহৎ ভূখণ্ডে যে-ফাটল দেখা দিয়েছিল, সেইটা সে এখন পুনরুদ্ধার করবে। ফেরত যাবে জারশাসিত রাশিয়ার বাতাবরণে, যেখানে রাশিয়া মানে ছিল আলাদা রাষ্ট্র। গোদারের ভাষায় বলা যাইতে পারে, রাশিয়া ইউরোপে অবস্থিত হইতে পারে কিন্তু সে কখনো ইউরোপে ছিল না।
রাশিয়া কেন বা কীভাবে স্বতন্ত্র ঠার পাইতে রুশ সাহিত্যিকদের কাছে ফেরত যাইতে হয়। পুশকিন-গোগোল-তুর্গেনেভ হইতে দস্তয়েভ্স্কি-তলস্তয়, এবং সেখান থেকে বরিস পাস্তারনাক বা সোলঝেনিৎসিনে যদি ফেরত যাই, যদি আন্না আখমাতোভা হইতে আন্দ্রেই তারকোভস্কি অবধি পরম্পরা নজরে আনি, তাহলে বুঝতে পারব সোভিয়েত আমলে দেখা দেওয়া বস্তুতান্ত্রিক সমাজবাদকে তাঁরা তলে-তলে মেনে নিতে পারেন নাই। এক ধরনের মরমি প্রতিরোধ জারি ছিল তখনো। ডুগিনের দার্শনিক অভিপ্রায় এখন সেইটাকে অ্যানক্যাশ করতেছে। কীভাবে? তার সংক্ষিপ্ত বিবরণে আমরা এখন গমন করতে পারি।
বস্তুবাদী সমাজ রাশিয়াকে অনর্থক গণ্ডির ভিতরে ফেলে দিতেছে;- আলেকজান্ডার ডুগিন পয়লা এই বিষয়টা আমলে নিতেছেন। তাঁর মতে গণ্ডিটা সেখানে সকল প্রকার দার্শনিক চিন্তনকে প্রতিহত করেতেছে। সোভিয়েত আমলে নতুন কোনো দার্শনিক প্রতিপাদ্য যে-কারণে তৈরি হয় নাই। সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক নবীকরণ বড়ো আকারে ঘটে নাই তখন। প্রোপাগান্ডায় আবিল যেসব বয়ান তারা পয়দা করছে তার সবটাই পচা। রাশিয়াকে আগে এই গণ্ডি হইতে টেনে বের করা প্রয়োজন। আগামীদিনের অর্থনীতি ও রাজনীতির মেরুকরণ মাথায় নিয়া ডুগিন তাঁর The Fourth Political Theory নামক দার্শনিক প্রস্তাবনা পেশ করছিলেন। ভলাদিমির পুতিন পরে একে অ্যানক্যাশ করে নতুন রাশিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বিদেশনীতি সাজাইছেন বলা যায়।
ডুগিন তাঁর কিতাবে মানববিশ্বে দেখা দেওয়া ভাবাদর্শ ও তার প্রভাবকে চারটি ভাগে ফেলে বিশ্লেষণ করছেন। তাঁর ভাষায়, মানবগ্রহে চারটি ভাবতরঙ্গ জাতিরাষ্ট্র গঠন, বিনির্মাণ ও নবায়নে বিরাট ভূমিকা নিভাইছে। প্রথম ভাবতরঙ্গ ছিল উদারতাবাদ। আম্রিকাসহ ইউরোপের বহু দেশ এর আলোকে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নটি ডিল করছে। প্রথম তরঙ্গে ছেদ ঘটিয়ে দেখা দিলো দ্বিতীয় ভাবতরঙ্গ। কমিউনিজম ও ফ্যাসিজম এই ভাবতরঙ্গের বড়ো অবদান। মানব-ইতিহাসে প্রথম ও দ্বিতীয় ভাবতরঙ্গের প্রভাব যুগান্তকারী ছিল। দ্বিতীয় ভাবতরঙ্গকে যারা গ্রহণ করতে পারে নাই বা গ্রহণ করার পর এর থেকে বের হয়ে আসে, তারা এখনাবধি জাতীয়তাবাদ, সমাজতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি ভাবাদর্শে আবর্তিত হইতেছেন। তিনটি ভাবতরঙ্গে গণতন্ত্র কোনো না কোনোভাবে একীভূত ছিল সদা। ডুগিনের তৃতীয় তরঙ্গে আমরা হয়তো ইসলাম কেন্দ্রিক উম্মাহ ভিত্তিক জাতীয়তাবাদকেও বিবেচনায় নিতে পারি। ফ্যাসিজমের নবীকরণ হিসেবে যাকে হয়তো ভাবা যায়।
চতুর্থ তরঙ্গের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যায় হাইডেগারের দর্শনকে প্রাসঙ্গিক করছেন ডুগিন। তাঁর মতে হাইডেগার হইতেছেন সেই দার্শনিক যিনি ইতিহাস ও ঐতিহাসিকতাকে পরিষ্কার ব্যাখ্যা করছিলেন। যতরকম ভাবতরঙ্গকে আমরা পৃথিবীতে প্রভাবশালী হইতে দেখি তার সবটাই ন্যারেটিভ তৈরির খেলা। কালের ধারায় সংঘটিত ঘটনাকে যারা ব্যাখ্যার নামে নিজ মাপমতো বাটখারায় ওজন করছে, এবং সেইটার ওপর অটল থেকে জাতি-রাষ্ট্র-সমাজের বনেদ গড়তে কার্পণ্য করে নাই। এর ফলে প্রকৃত ইতিহাস বা কালের আবর্তে তার স্বাভাবিক গতি বারবার বিঘ্নিত হইছে। এমন কোনো ঐতিহাসিক অভিজ্ঞানের নিকটে মানুষ ফেরত যাইতে পারে নাই যেটি মানব বিরচিত নয়। মানুষের সৃষ্ট ইতিহাসকে যদি অবিরত প্রশ্ন করা যায় তাহলে আমরা সেই ইতিহাসে পৌঁছাইতে পারি;- এবং এই ইতিহাস নিখাদ সহজ ও প্রাকৃতিক। মানুষ সেখানে অ্যাক্টর কিন্ত নিয়ন্ত্রক নয়। সেখানে সে এইটা ভাবে না,- নদীর ওপর যোগাযোগের সেতু কীভাবে তৈরি করতে হয় তার সবটাই সে একাই আবিষ্কার করছিল, সুতরাং সে হইতেছে উদ্ভাবক ইত্যাদি।
হাইডেগার তাঁর দ্য কোয়েশ্চন কনসার্নিং টেকনোলজি নামক পুস্তিকায় পরিষ্কার নিদান হাঁকছিলেন,- মানুষ সেতু তৈরির কৌশল রপ্ত করতে পারছে তার কারণ প্রকৃতিমধ্যে নিহিত। সেতু নির্মাণের সকল উপাদান প্রকৃতিবক্ষে মজুদ থাকায় তার পক্ষে সেতু তৈরি করা সম্ভব হইছে। সেতু কীভাবে তৈরি করতে হবে সেইটা জানার আগে পর্যন্ত প্রকৃতিবক্ষে সংরক্ষিত উপাদানগুলাকে সে ব্যবহার করতে পারে নাই। যখন জানতে পারছে তখন সেতু নির্মাণে বাধা থাকে নাই। এই অর্থে তাকে আমরা অন্বেষক বা এক্সপ্লোরার ভাবতে পারি। সে এখানে আবিষ্কারকের ভূমিকা পালন করতেছে। সেতু তৈরির জন্য যদি তাকে আমরা ইনভেনটর বা উদ্ভাবক বইলা ভাবি তাহলে সেইটা ভুল।
সেতু তৈরির সমুদয় উপাদান প্রকৃতিবক্ষে সে আবিষ্কার করছে, কিন্তু নিজে এর একটাও সৃষ্টি করে নাই। অবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মধ্যে নিহিত পার্থক্যটি বিস্মৃত হওয়ার কারণে আমাদের ইতিহাসবোধ ও এ-সংক্রান্ত বয়ান আর সঠিক নেই। এর ফলে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক জটিল রূপ ধারণ করছে। প্রকৃতির সঙ্গে তার বিচ্ছেদে যা গুরুতর ভূমিকা পালন করছিল। মানুষ এখন প্রকৃতির ওপর জয়ী বা তাকে শাসন করার কথা ভাবে। প্রকৃতিবক্ষে একীভূত হয়ে সেখানে সংরক্ষিত উপাদানগুলা ব্যবহারের ভাবনায়ি সুস্থির হইতে পারে না। ইতিহাস সংক্রান্ত সকল বয়ানে যে-কারণে আমরা আধিপত্য দেখি, সহাবস্থানকে যেখানে বিরল মনে হয়। এই ইতিহাস কাজেই প্রকৃতিনিষ্ঠ কোনো ইতিহাস নয়। মানুষ যদিও স্বয়ং প্রকৃতির সন্তান বইলা বিদিত!
মানব বিরচিত সকল ইতিহাস আধিপত্যবাদের ইতিহাস;- সমন্বয় ও সহাবস্থানের নয়। এই ইতিহাসকে যদি প্রত্যাখ্যান করা না যায়, মানুষের পক্ষে সহাবস্থানের সমাজরাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব নয়। এমন বয়ান চাই যেইটা মানবরচিত মানুষ কেন্দ্রিক ধারণার বাইরে আসতে আমাদেরকে তাগাদা দিয়া যাবে। সত্তার প্রকৃত স্বরূপের খোঁজ নিতে বলবে সে। মনুষ্য বিরচিত সকল জ্ঞান ও ভাবধারাকে প্রশ্ন করতে প্ররোচিত করবে। বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ের বাইরে গিয়া ভাবতে উসকানি দিতে থাকবে অবিরত। অন্তর্দৃষ্টি সহকারে ইহজাগতিক সমস্যায় ক্রিয়াশীল হইতে মজবুর করবে আমাদের। যেখানে কিনা চিন্তা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে না বরং সহকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। আগামীর ভাবতরঙ্গ ও তার রাজনীতি, ডুগিন মনে করেন এই চতুর্থ বা ফোর্থ পলিটিক্যাল থিয়োরির ওপর নির্ভর করবে অনেকখানি। যে-কারণে মানুষকে প্রচলিত জাতীয়তাবাদের বলয় থেকে বাহির হয়ে আসা প্রয়োজন।
এখন, ডুগিনের দার্শনিক প্রস্তাবনাকে পুতিন যেভাবে ব্যবহার করতেছেন সেইটা কতখানি সঠিক? প্রশ্নটি আমরা উঠাইতে পারি বোধহয়। মানতে হবে, উনার প্রস্তাবনা পুতিনের হাত দিয়া বরং কেন্দ্রিকতাকে বিচ্যুত করার বাহানায় স্বয়ং নয়া আঙ্গিকে সৃষ্ট কেন্দ্রিকতা ও রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ প্রসবে ভূমিকা পালন করতেছে। পশ্চিমারা যে-কারণে ডুগনিকে পুতিনের রাসপুটিন ও ফ্যাসিস্ট ভাবধারার জনক বইলা উপহাস করে থাকে।
ইউক্রেনে আক্রমণ হইতেছে প্রথম পদক্ষেপ যার ভিতর দিয়া রাশিয়া প্রথমত ইউরো-মার্কিন আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে সক্রিয়। দ্বিতীয়ত চীন-ভারত-মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে জোট তৈরির মাধ্যমে ইউরো-মার্কিন বলয়ের বাইরে শক্তিশালী বলয় তৈরিতে নিমগ্ন। তৃতীয়ত রাশিয়াকে ক্যাথলিক খ্রিস্টীয় ভাবধারায় অবগাহন করানোয় তৎপর। স্থানিক ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ভ্যালু দিতে গিয়ে অন্যের ওপর তার ভার চাপানোর খাসলত চতুর্থ রাজনীতির থিয়োরিতে বিদ্যমান বটে। সংকীর্ণ স্থানিক জাতীয়তাবাদের প্রকোপ হইতে নিজেকে যেখানে মুক্ত রাখা কঠিন। ডুগিন একদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংসে আপসহীন, অন্যদিকে রাশিয়াকে তার আদি ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে ফেরত নেওয়ার প্রশ্নে তাঁর কৌশল বিপজ্জনক। ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ডুগিন ও পুতিন উভয়ে যেমন ইউরো-আমেরিকা প্রযোজিত ট্রান্সজান্ডার মুভমেন্টকে রাশিয়ায় প্রতিহত করার স্বপক্ষে একাট্টা হইছেন। উনাদের এই অবস্থানকে অবশ্য ট্রান্সজান্ডার মুভমেন্টে নিহিত রাজনীতি মাথায় নিলে নাকচ করা কঠিন।
উপরোক্ত সব কার্যকারণে ফোর্থ পলিটিক্স বা চতুর্থ রাজনীতির ধারণা পুরাটাই বিতর্কিত। দার্শনিক বুনিয়াদের ওপর জাতি-রাষ্ট্রের মানস গঠনের বিপদ এখানে নিহিত। দার্শনিক বুনিয়াদ গঠন ছাড়া বিশৃঙ্খলা ঠেকানো কঠিন হয়, যার মধ্যে আমরা এখন বাস করি। আবার কোনটাকে নিলে পরে জাতিরাষ্ট্র সংহত কিন্তু আধিপত্যবাদী হয়ে উঠবে না, তার কিনারা করা মানুষের পক্ষে আজো সম্ভব হয় নাই। আমাদের মতো ছোট একখান দেশে একদিকে পুঁজিবাদ প্রসূত বৈশ্বিক ভাবতরঙ্গ মোকাবিলার সমস্যা বিদ্যমান। অন্যদিকে রাশিয়া-চীন-ভারত যে-জায়গা থেকে বিকল্প পরাশক্তি রূপে আবির্ভূত হইতেছে, এখন এর সঙ্গে একীভূত হওয়া ভালো নাকি প্রত্যাখ্যান উপকারী অথবা ভারাসাম্য নিরাপদ ইত্যাদি নিয়া জটিলতা বিস্তর।
সব বাদ দিয়া যদি আসিফ মাহতাবের প্রস্তাবনা মোতাবেক ইসলামি ভাবতরঙ্গ বা তার নৈতিক সারবস্তুতে যদি ফেরত যাইতে চাই সেখানেও বিপদ ষোলআনা। এহেন প্রস্তাবনা আখেরে ফ্যাসিবাদে রূপ নিতে পারে সহসা। জগাখিচুড়ি ভাবতরঙ্গের মধ্য থেকে আমাদের জন্য খাপ খায় এরকম ধারণা কেবল আমরা বেছে নিতে পারি। বাঙালি জাতিসংকর। তার দার্শনিক ভিত তৈরির ক্ষেত্রে বিষয়টিকে উপেক্ষার সুযোগ নাই। সে মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যে সহজাত;- কোনোপ্রকার একচ্ছত্রবাদে নয়। আসিফ মাহতাব কথাখান ইয়াদ রাখলে ভালো হয়।
. . .
. . .
The Fourth Political Theory by Alexander Dugin; PDF Edition
. . .