গত দশ বছর ধরে সমাজমাধ্যমে প্রভাববিস্তারী পিনাকী ভট্টাচার্য ও তার পথানুসারী কিছু লোকের ভিডিওজালে বাংলাভাষী নেটিজেনদের বড়ো অংশ বন্দি আছেন। সহসা বের হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। পিনাকীর ভিডুবকুনি দর্শক ইন্সট্যান্ট নুডুলসের মতো গিলে ফেলে। হজম করে তাৎক্ষণিক। তিন ঘণ্টা আগের ভিডিওতে তিনি কী কথা বলছে আর এখন বলতেছে, সেগুলা কারো ইয়াদ থাকে না। তার তৈরি ম্যাটিক্সে কোনোকিছু স্মরণ রাখার দায় দর্শকের নাই। এসব নিয়া প্রশ্ন তোলার ঠেকাও বোধ করে না তারা। পিনাকীর ম্যাট্রিক্স এদিক হইতে দারুণ জিনিস। পডকাস্ট পয়দার কারখানায় তাকে বাংলার অ্যান্ড্রু টেট ভাবা যাইতে পারে? কাজকারবারে টেটসুলভ না হইলেও পাঞ্চলাইন ঢোকানোর তরিকায় মিল আছে বৈকি।
অ্যান্ড্রু টেটকে নিয়া নেটিজেনরা দুনিয়া জুড়ে একসময় খেপে উঠছিল। পুঁজিবাদী বিশ্বে সক্রিয় সিস্টেম কীভাবে মানুষকে ম্যাট্রিক্সে বন্দি রাখে, প্রতিপদে দাস হইতে বাধ্য করে তারে, এসব নিয়া বকুনির সুবাদে অ্যান্ড্রুর উত্থান ঘটে। বিষয়গুলা মানুষের অজানা ছিল এমন নয়, কিন্তু অ্যান্ড্রু উপস্থাপনাগুণে নতুন বইলা বোধ হইতে থাকে সবার কাছে। তার বাক্যজালে কাজেই ম্যালা লোক তখন সম্মোহিত হইছিলেন। কথা মিথ্যা নয়, করোনা অতিমারির দিনগুলায় সে যখন ম্যাট্রিক্স নিয়া হাজির হয়, নেটবিশ্বে চমকের ঝড় উঠছিল। তারা চায় না এই মেট্রিক্সের কথা তুমি জানো;- চটকদার ব্যানারে কিক বক্সিংয়ে চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান অ্যান্ড্রুর মুখ দিয়া কথার ফুলঝুরি ছিল দেখার মতো ঘটনা! পয়লা দফায় যে-কেউ প্রভাবিত হইতে বাধ্য।
তার মনে হবে, আসলেই তো কিছু লোক মিলে এমন একখানা মেট্রিক্স তৈরি করছে যার ভিতরে আমরা বন্দি হয়ে আছি! আমাদের কোনো স্বাধীনতা নাই। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি, অফিস-আদালত ও সওদাগরির সবটাই ম্যাট্রিক্সে মোড়ানো। ভেড়ার পালের মতো সেখানে সকলে মিলে ঢুকতেছি ও পাক খাইতেছি! সাজানো ম্যাট্রিক্সে বসে আমরা বিদ্যালয় যাই, ব্যবসায় টাকা খাটাই, ব্যাংক হইতে ধার করি, বাজারে গিয়া পণ্য খরিদ করি। প্রেমপিরিত হইতে দোচাদুচির সবটাই ম্যাট্রিক্সের বাইরে গিয়া সারবার উপায় বন্ধ। তাদের কথা আমলে নিলে আমরা ভালো, না নিলে শত্রুপক্ষের এজেন্ট! সোজা কথায় ম্যাট্রিক্স সিনেমায় দেখানো জগতে আমরা বসবাস করতেছি! কথা বলার স্পেস যেখানে নাই। আমরা গাধার দল সেসব আমলে না নিয়া নিজেকে স্বাধীন ভেবে বিভ্রমের জীবন কাটাই প্রতিদিন। অ্যান্ড্রু টেট যখন জানাশোনা বিষয়গুলা তার ভিডিও পডকাস্টে তুলে ধরে, দর্শকের মনে হইতে থাকে কথাগুলা তার হয়ে সে বলতেছে সেখানে। ম্যাট্রিক্স বোঝানোর ছলে এভাবে নিজের তৈরি ম্যাট্রিক্সে দর্শককে বন্দি করে সে। অগভীর ও অন্তঃসারশূন্য বুলির আড়ালে যা তাকে রাতারাতি সেলিব্রেটিতে পরিণত করছিল।
কিক বক্সার অ্যান্ড্রু এভাবে ধনী থেকে আরো ধনী হইতে থাকে আর দর্শকের কপালে জোটে আন্ডা। অ্যান্ড্রুর সঙ্গে এখানে অবশ্য পিনাকীর তফাত আছে। উনি টাকা কামানোর মতলবে ভিডু করে না। তার মতলব আরো ব্যাপক সেখানে। দেশের ক্ষমতা কাঠামোয় সক্রিয় ম্যাট্রিক্স নিয়া খেলা করার খোয়াবে বিভোর থাকেন এই ভিডুসেলেব। স্বপ্ন দেখেন,- আজ-নয়-কাল তার দেখানো বিপ্লবের ম্যাাট্রিক্সে পাবলিক ঢুকবে, আর তখন উনি অ্যায়সা জাদু ঢালারে কায়দায় সবাইকে আইটেম নাচ নাচতে বাধ্য করবে।
উত্থানের পর হইতে অ্যান্ড্রু টেটকে দর্শক বিচিত্র রূপে দেখতে আছেন! ইংলান্ডের লোটন শহরে খাবার টোকানো টোকাই থেকে কিক বক্সিংয়ে চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান অ্যান্ড্রু দামি গাড়ি চড়ে। সুন্দরী মেয়ে বগলে নিয়া ঘোরে। মন চাইলে তাদের ধরে পিটায়। নারীবিদ্বেষের অভিযোগ তিরের মতো তার দিকে যখন-তখন ধায়। অ্যান্ড্রুর তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। তার কথা হইতেছে,- সে মিসোজিনিস্ট নয়। কস্মিনকালে ছিলও না। নারীদের পুরুষ-নির্ভরতাকে ক্রিটিক করা যদি নারীবিদ্বেষ হয় তাইলে তার বলার কিছু নাই। মেয়েদের বোঝা উচিত তারা স্বেচ্ছায় পুরুষের হাতে গড়া ম্যাট্রিক্সে বন্দি থাকতে ভালোবাসে। পৌরুষ হইতেছে এমন একখান ঘটনা যার অধীনে একজন নারী নিজের নিরাপত্তা তালাশ করে। একটা মেয়েকে পিটানোর অর্থ হলো তারে সেই ম্যাট্রিক্সের ব্যাপারে সচেতন করা।
আমাকে এখন পাল্টা মাইর দিতে হবে, যদি না দেই তাহলে ম্যাট্রিক্স থেকে বের হওয়া যাবে না;- এই উপলব্ধি নারীমনে জাগ্রত করার কাজটাই সে করতেছে এখানে, যদিও নারীবাদীরা তা বুঝতে অক্ষম। মেয়ে পিটানো ও ধর্ষণের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার বা নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা সেখান থেকে আসতেছে, যার পুরোটাই তাদের বানানো স্ক্যাম। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি হইতে ব্যাংক কিংবা শেয়ার বাজার যেভাবে তৈরি করা হইছে, যেভাবে মানুষকে জিম্মি করা হইছে সেখানে,- অনুরূপ এক ছকে তার নামে এখন তারা স্ক্যাম পয়দায় ব্যস্ত।
অ্যান্ড্রু টেট রংবাজ আদমি তাতে সন্দেহ নাই। রুমানিয়ায় গিয়া সে হাঙ্গামা পাকায়। সরকার তাকে মেয়ে পিটানোর অভিযোগে গৃহবন্দি করে। সেখান থেকে বের হয়ে আচমকা ইসলামের পক্ষে ওকালতি শুরু করে। কোরান হইতে জ্ঞান ঝাড়ে। লন্ডন-আম্রিকায় মর্দে মুমিন হইতে উতলা প্রজন্মের হিরোতে পরিণত হয় রাতারাতি। জিহাদের মামলা অ্যান্ড্রু সবাইকে বোঝায় অকপট। বেচারা সত্যি ইসলাম নামক ম্যাট্রিক্সে ঢুকছে নাকি এর পুরাটা স্ক্যাম;- এসব নিয়া আবার ইসলাম অনুরক্ত নেটিজেন মহলে পাল্টাপাল্টি বিবাদ চলতেই থাকে। ইসলামভীতি প্রতিহত করতে মরিয়া ফাইভ পিলারস ও ব্লাড ব্রাদার্সের ব্যানারে সংগঠিত সিলটি ব্রিটসরা ওদিকে আবার অ্যান্ড্রুকে নিয়া পডকাস্ট করে ব্যাপক। ফিলিস্তিনের স্বপক্ষে চলমান জিহাদে নওম চমস্কির মতো অ্যান্ড্রুকে তারা ব্যবহার করে। নব্বই পার চমস্কি জানতেও পারেন না এই ছেলেগুলো আসলে কে? কী তাদের পরিচয়! নিজস্ব বয়ানে বরাবর অটল বুদ্ধিজীবী ইসলামভীতির বিরুদ্ধে যুবকরা লড়ছে ভেবে সাক্ষাৎকার দিয়া যাইতে থাকেন।
চমস্কি হইতে অ্যান্ড্রু… ফাইভ পিলারস-এর ছকে শেখ হাসিনার বেইল নাই। দ্য হেট হাসিনা এন্ড শেখ মুজিব। বিএনপিও তাদের ঘোর অপছন্দ। জামায়াতে ইসলামি মনপসন্দ। তারা মনে করে জামায়াতের পক্ষে বাংলাদেশকে ইমানি পথে নেওয়া সম্ভব। সেই ইমান যেখানে ইসলাম ও আধুনিকতাকে একত্র করে ম্যাটিক্স তৈরি কঠিন কিছু না। ইসলামি পঞ্চস্তম্ভের ম্যাট্রিক্সে বন্দি সিলটিরা অ্যান্ড্রুকে দিয়া নিজ মতলব হাসিলে আগুয়ান। আজিব কিসিমের কাজকারবার দিয়া গড়া ম্যাট্রিক্সে এভাবে সকলে কমবেশি অগ্রসর বটে!
অ্যান্ড্রু টেট হইতে সিলেটি ফাইভপিলারস… এনারা সকলেই পুঁজিবাদী বিকারে মোড়ানো সভ্যতায় নতুন উপজাত। তাদেরকে যারা তৈরি করে তারা হইতেছে আসল খেলোয়াড়। এখন তারা ম্যাট্রিক্স ছবির মরফিউস নাকি এজেন্ট স্মিথ তার কিনারা করা কঠিন। সহজ হলো এইটা ভেবে নেওয়া,- বাস্তবতা হইতেছে বিভ্রম। আমরা সবাই হয় লাল বড়ি নয়তো নীল বড়ি সমানে গিলতেছি। যে-বড়ি গিলি না কেন, একটা-না-একটা ম্যাট্রিক্সে নিজেকে বন্দি রাখতে আমরা বাধ্য। সেখানে ঢোকার পর যা দেখানো হয় বা হইতেছে… আমাদের জন্য সেইটা হলো বাস্তব! বাকিটা পুরাই অলীক। অ্যান্ড্রুর দাম এখানে এটুকুন,- নিজ মতলব হাসিলে ম্যাট্রিক্স নিয়া বকুনি দিলেও সারকথা কিছু ভুল বলে নাই। বড়ো কথা, তারে তো আমাদের এখন স্লাভয় জিজেক ভাবলে হবে না। জিজেকের পরিহাসদীপ্ত কথাবার্তায় মজা ও গভীরতা সমান মজুদ থাকে। বলকান ধাঁচের ইংরেজি বুলিতে উনি যা করে তার সমতুল কিছু কল্পনা করাও কঠিন!
ইংরেজি বুলি ও দৈহিক অঙ্গভঙ্গি দিয়া জিজেক পয়লা নিজেকে আলাদা প্রতিপন্ন করেন। জিজেকের মুখ হইতে নির্গত ইংরেজি শুনে মনে হবে ভাষাটারে নিয়া মশকারা করতেছে উনি। দর্শকের কিন্তু বিষয়টি মাথায় থাকে না। তারা ভাবে মানুষটা ইংরেজিভাষী নয়। বলকান হইতে আসছেন। ইংরেজি উচ্চারণ এমন হইতেই পারে। দর্শকের ধারণা আমার কেন জানি ভুল বইলা মনে হয়। জিজেক ইংরেজি ভালো জানেন। ইচ্ছা করলে চোস্ত বলতেও পারবেন। কিন্তু তিনি ইংরেজির মান চেহারাকে ডিনাই করার মতলবে ওসব করেন। হাজার হোক, স্লাভয় জিজেক তাঁর নিজ পন্থায় আগাগোড়া সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, যেখানে উনার অবস্থান ধ্রুপদি নয় বরং যুগানুবর্তী। ধ্রুপদি মার্কসবাদ নিয়া তাঁর সমালোচনা যে-কারণে তীব্র। পুঁজিবাদ যা-কিছু চাপায় ও মান বইলা জাহির করতে চায়,- জিজেক তাঁর তরিকামতো তাকে বাহবা দেওয়ার ছলে খারিজ করতে থাকবেন। একধরনের গেরিলা ওয়ারফেয়ার এই চিন্তকের মধ্যে সর্বক্ষণ সক্রিয়।
স্লাভয় জিজেককে এই জায়গা থেকে আমরা রোদ্দুর রায়ের রিফাইনড ভার্সন ভাবতে পারি। রোদ্দুর যেমন রবি দাদুর গান ইচ্ছে করলে ভালো গাইতে পারবে, কিন্তু উনি গাইবে না। তার লক্ষ্য, বাঙালি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ ও সুশীল বাহিনি;- ওই যারা নন্দন ও শান্তিনিকেতনে সংস্কৃতি মারাতে যায়, তাদেরকে ধরে পিটানো। যাদের হাতে পড়ে রবি ঠাকুর আর নাই রবি ঠাকুর। তাঁকে এমনভাবে বন্দি করা হইছে,- খেটেখাওয়া মানুষের কাছে ঠাকুরকে পৌঁছানোর সকল উপায় বন্ধ। রোদ্দুর রায় অগত্যা খিস্তি দিয়া সার্কাজমটা করেন। খিস্তির বদলে আজব ইংরেজি বুলি ও দেহের অস্থির নড়াচড়ার মধ্য দিয়া কর্মটি সারেন জিজেক। গালি একটাও বাহির হয় না মুখ দিয়া, কিন্তু ইংরেজি যেভাবে বাহির হইতে থাকে, শুনে মনে হবে মশকরা জুড়ছে এই লোক। তার সঙ্গে আছে দেহের নড়াচড়া। আছে নিজের উন্নাসিক নিরাশা তুলে ধরার ছলে ধাম করে প্রতিপক্ষের নাকে ঘুঁষি বসানো। জিজেকের সবটাই ভীষণ উপাদেয়।
এই লোক সেমিনারে উপাদেয়। পডকাস্টে উপাদেয়। ইউভাল নোয়া হারারির মতো কারো সঙ্গে সিরিয়াস আলাপের ক্ষণেও উপাদেয়। তাঁর দেখার ভঙ্গি, বলার ভঙ্গি, বিশ্লেষণের ভঙ্গি, প্রতিপক্ষকে ঠ্যাঙানির ভঙ্গি, এবং ফাইনালি কমিক একখান ক্যারেক্টার রূপে নিজেকে নিয়া তামাশা করার কায়দা, যার মধ্য দিয়া চলমান সময়কে হয়তো কমিক বইলা রায় দিতে থাকেন জিজেক। ভাইরে, এসব কেরামতির অনুকরণ অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ওই লেভেলের গভীরতা থাকলেও জিজেকগিরি বিপজ্জনক। সমস্যা হলো তাঁর প্রতিপত্তি দুনিয়ার যত মোটিভেশনাল স্পিকার ও পডকাস্ট গুরু আছেন, তাদের ওপর গভীর। তারা সকলে, আমার ধারণা, কমবেশি মনে-মনে স্লাভয় জিজেক হইতে চায়। অনেকসময় এইটা না বুঝে,- জিজেকের দার্শনিক বোধি একদম পাক্কা।
জাক লাকাঁর পরে আরেকজন চিন্তক, যিনি পরিকল্পিতভাবে মতলবি ও উচ্ছৃঙ্খল। সবকিছু নিয়া সিরিয়াস মুডে ইয়ার্কি মারবে। যখন মারবে তখন সেইটা চমস্কির মতো গুরুজনের মনে বিরক্তি পয়দা করলেও আমরা এনজয় করি বিলক্ষণ। চমস্কি জাক লাকাঁকে সইতে পারতেন না। তাঁর মনে হইত এই ব্যাটার মধ্যে গভীরতার চাইতে প্লেবয় টাইপের জাঁক আর ভড়ং বেশি। চিন্তার গভীরে যাওয়াকে সে তার ওই মেয়ে পটানো আর তাদের নিয়া ছেলেখেলার মতো ঘটনা বইলা ভাবে। বাংলায় জাক লাকাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত সলিমুল্লাহ খান মেয়ে পটানোর কারবারি না হইলেও ছফা এবং লাকাঁয় শহিদ সলিমুল্লাহর মধ্যে মেয়েমানুষ ডিল করা নিয়া যথেষ্ট ঝামেলা দেখা যায়। শেখ তসলিমা মুনের যদ্যপি আমার গুরু পতি এক্ষেত্রে পাঠ করা যাইতে পারে। সলিমুল্লাহ খানকে খাটো না করেই উনার প্রব্লেম বইয়ে ডিফাইন করছিলেন তসলিমা মুন।
সলিমুল্লাহ খান, ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট, উনার গুরুভাই লাকাঁর প্রভাবে মনে হইতেছে চমস্কিকে পছন্দ করেন না। এই রায় কিছুদিন আগে এলান করছিলেন,- চমস্কি কোনো বড়ো চিন্তাবিদ না। ভাষাবিজ্ঞানে তাঁর অবদান নাকি অতিরঞ্জিত। লও ঠ্যালা! ভাবতেছি হুমায়ুন আজাদ জীবিত থাকলে জমত খুব। আফটার অল, আজাদে সস্যুর ও চমস্কির রিকগনিশন ভালোমতন ছিল। আর স্টিভেন পিঙ্কার তাঁর ব্ল্যাঙ্ক স্লেট (স্মৃতিদোষে যদি ভুল না করি) কিতাবে চমস্কিকে ভাষাবিজ্ঞানের মুরব্বি ও পিতামহ বইলা সম্মান জানাইতে কৃপণতা করেন নাই।
নওম চমস্কি ক্ষেত্রবিশেষ আমাদের জন্য হেভিওয়েট বক্সার। স্লাভয় জিজেক সেখানে মোহাম্মদ আলীর উপমা। আলীর বড়ো সম্পদ ছিল তাঁর রিফ্লেকশন। বেশিরভাগ সময় মার খাইত। প্রজাপতির মতো নেচে-নেচে প্রতিপক্ষকে প্রলোভিত করত যেন সে তারে মারে। মুখের উপ্রে ঘুঁষি আটকানোর টেকনিক আলীর ভালো জানা ছিল। পেটের মাংসপেশির সাইড দিয়া যাইতে দিতো বেশিরভাগ। তারমধ্যে আচমকা হাত চলত আলীর। প্রতিপক্ষ কিছু বুঝে ওঠার আগে টের পাইত আলী তার মুখ বরাবর ঘুঁষি ঝেড়ে দিছে। বাটারফ্লাই মুভ কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষের নাক বরাবর ধা করে পাঞ্চ বসানো বক্সার ছিলেন মোহাম্মদ আলী। যারা ইভানন্ডার হোলিফিল্ড আর জো ফ্রেজিয়ারের সঙ্গে আলীর ইতিহাসবিখ্যাত ফাইটের ভিডিও দেখছেন তারা বুঝবেন কী বুঝাইতেছি। হোলিফিল্ড যে-কারণে বইলা গেছেন, মোহাম্মদ আলী বক্সিংয়ের চেয়েও বড়ো কিছু ছিল। জিজেক এখানে আলীর মতো অনেকটা। এমন এক প্রজাপতি যে-কিনা গুরুতর বিষয় নিয়া ইয়ার্কির ছলে দ্রুত হাত চালায়। দার্শনিক বোধি উসকাইতে বাধ্য করে।
স্লাভয় জিজেকের থেকে কাজেই শেখার মালমসলা প্রচুর। যদিও উনি প্রতিপদে এইটা ক্লিয়ার করে আগাইতে থাকে,- আমি ভাই মানবগ্রহ নিয়া নিরাশ! এখন এই নিরাশ মালটার ব্যাপারে নিজে শিখতে ও কাউকে শিখাইতে আগ্রহী না। তো এই লাইট বাট হেভি স্লাভয় জিজেক যে-রাস্তা দেখান, সেই পথে যাইতে গিয়া অনেকে হোঁচট খায় ও লোক হাসায়। অ্যন্ড্রু টেট তার মধ্যে অন্যতম।
লরেলাপ্পা গেঞ্জি প্রজন্মের প্রবল উত্থানের যুগে সবটাই দেখতে সলিড মনে হয় কিন্তু ভিতরটা ফোঁপরা। অ্যান্ড্রু টেট ও জিজেককে যদি একত্রে মিশানো যায় তাহলে প্যানিক বাবার মতো দেখতে কিছু একটা পাওয়া যাইতেও পারে। পিনাকীর মধ্যে মর্দানি ও পরিহাসমাখা হুল আছে বটে। বাংলার ধাঁচে আছে। সমস্যা হইল জিজেক কিংবা অ্যান্ড্রুকে লোকজন শুনে, যে-যার মতো অনুপ্রাণিত হয় অথবা হয় না, এবং দিনশেষে তাঁদের প্রভাব শূন্য হইতে থাকে। পিনাকী এখানে এসে গুরুতর। তার প্রভাব আপাতদৃষ্টে দীর্ঘস্থায়ী বইলা ধরে নিতে হইতেছে।
পনেরো বছরের হাসিনাবিরোধী যুদ্ধে পিনাকীর অ্যাক্টিভিজম এমন এক মাত্রায় তাকে নিয়ে গেছে, গেঞ্জি প্রজন্ম ও তাদের বাপ-মাদের হাতের টুসকিতে নাচানো তার জন্য কঠিন না। পরিস্থিতি যদি এমন দাঁড়ায় কখনো, পরম প্রিয় গুরুভাই ফরহাদ মজহারকে পচাতে হবে,- পিনাকী সে-কাজ করতে দ্বিধা করবেন বইলা মনে হয় না। উনি যা পারবে না, যেখানে উনি আটকা আছে এখন, সেইটা হইতেছে ইসলামিস্টদের পচানোর সাধ্য তার নাই। পচাইতে যদি হয় তাহলে ভক্তকুলের বিরাট অংশের মায়া তাকে ত্যাগ করতে হবে। এই ম্যাট্রিক্স ভাঙার হ্যাডম উনি আপাতত রাখেন না।
মাস দুই আগে জেনারেল ওয়াকারকে নিয়া নিজের এক ভিডিও পডকাস্টে জিয়া হাসান বলছিলেন,- পিনাকী ইসলামি ম্যাট্রিক্স ত্যাগ করে বেরিয়ে আসবে যদি দেখে সেইটা তারে বেনিফিট দিতেছে। এরকম ভিত্তর সজাগ লোক বাংলায় বেশি আসে নাই। যে-কারণে জিয়া হাসানের সঙ্গে এই ব্যাপারে সহমত হওয়া যাইতে পারে,- পিনাকী ইচ্ছা করলে ইউনূস সরকারের ভিতরে যারা সক্রিয় তাদেরকে বিব্রত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার ক্ষমতা রাখে। এর সঙ্গে জামায়াতি ইলিয়াস হোসেন যদি জোটে তাহলে কাম সারা। জেন-জি প্রজেন্মের ওপর এই দুজনের প্রভাব ধংসাত্মক। যে-প্রভাব ইতোমধ্যে অনেক লোকের মরণের কারণ হইছে, এবং এখনো হইতেছে।
জিয়া হাসানও কম কিসে? তার সেই ডিডুবকুনিতে দেখলাম ধাম করে বলে বসছেন,- শেখ হাসিনা নাকি এক লক্ষ লোক মারার প্ল্যান করছিল। হাসিনা যত লোক মারছে এবং পরে যারা মারা পড়ছে… তুলনামূলক সংখ্যা বিবেচনায় পরেরটা মাইনর। হাজাড় দেড়েক কোনো ব্যাপার না। তার মানে লাখ খানেক মরলে বোধহয় উনার বিপ্লবী জান তৃপ্ত হইত। জিয়া হাসান বা পিনাকীর মতো লোকজন স্বয়ং আরো বড়ো ফ্যাসিবাদের ম্যাট্রিক্সে বসে বকুনি ঝাড়লেও দর্শকের ভূমিকা সেখানে বোবা-কালা-কানার বেশি নয়। সব বুঝেও না বোঝার ভান করতেছেন তারা।
জিয়া হাসান কী করে নিশ্চিত হাসিনা লাখ খানেক লোক মারার প্লান করছিল। অ্যাভিডেন্স আছে তার কাছে? দেখাইতে পারবে সেগুলা? না, পারবে না। উনি যেইটা করবে সেইটা হলো ইলিয়াসের মতো শতভাগ মিছেকথায় সাজানো স্টোরি তৈরি করবে তাৎক্ষণিক। আর্গুমেন্ট করা যায় না এমন স্টোরি তৈরি করবে। গজবি রেফারেন্স দিবে। মনে হবে হাসিনা সরকারের ভিতরে থাকা কোনো লোকের কাছ থেকে সোর্স পাইছে। তার সঙ্গে হাসিনার পনেরো বছরের কাজকারবারকে ব্যাখ্যা করবে, যাতে বানানো গল্প লোকে বিশ্বাস করে।
ন্যারেটিভ তৈরির খেলায় তারা সকলে কমবেশি পারঙ্গম। তাদের ম্যাটিক্সের এইটা হইতেছে শক্তিশালী দিক। নিজেও জানে ব্লাফ দিতেছে, ইলিয়াস যেমন অকপটে বলে এখন, সে আর সাংবাদকিতা করে না, এবং জেনেবুঝে মিথ্যাকে ব্যবহার করে। তো এসব মিথ্যাকে তারা এমনভাবে ডেলিভারি দিতে থাকে,- একসময় স্বয়ং সেই মিথ্যাকে তারা সত্য ভাবতে থাকবে। ফ্যাসিবাদের বড়ো অনুষঙ্গ হইতেছে মিথ্যা পয়দা করার ক্ষমতা। লাই ম্যাট্রিক্স ছাড়া সে টিকতে পারবে না। সুতরাং পিনাকী গং অবিরাম গোয়েবলস লাই পয়দা করতে বাধ্য। মিথ্যা যদি তাদের গলা চেপে ধরে, তথাপি এছাড়া উপায় নাই। ওইটা পয়দা করতে না পারলে মরণ।
. . .
. . .