দেখা-শোনা-পাঠ

তাসনিফ জামান ও রোড ৩১

বাংলা ব্যান্ড গানে গোল্ডেন টাইম বইলা আমরা যে-কালপর্বকে বুঝি তার রেশ তখনো ফুরায়া যায় নাই, কিন্তু ভাটার টান শ্রোতারা টের পাইতেছিলেন বেশ। তো সেই কালপর্বে রোড ৩১ নামে একখানা ব্যান্ডের আত্মপ্রকাশ ঘটছিল। তাসনিফ জামান ছিলেন ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট। গানের কথা নিজে লিখতেন। স্বল্পায়ু ব্যান্ডের তালিকায় রোড-৩১ অন্যতম। গুটিকয় গান তারা পরিবেশন করেন। শ্রোতাপসন্দ হইতে থাকার সূচনায় বিলুপ্তি ঘটে ব্যান্ডের। বড়ো কারণ, লিড ভোকালিস্ট তাসনিফ জামানের সামরিক বাহিনিতে যোগদান। আর্মিতে কেন জয়েন করছিলেন সেইটা তিনি ভালো জানে, তবে মাকসুদ, বাচ্চু, জেমস, খালিদ ও হাসান পরবর্তী ব্যান্ড গানে হাহাকার জাগানিয়া গানের আবেদন রোড ৩১ বহন করতেছিল। তাসনিফের গায়কির কারণে যা অন্য লেভেলে যাওযার সম্ভাবনায় দীপ্ত ছিল বটে।

Tasnif Zaman – Lead Vocalist Road-31 Band; Image Source – Google Image

রোড ৩১-এর হাতে গোনা গানের মধ্যে উৎসর্গ নিঃসন্দেহে সিগনিফিকেন্ট। আমার সবটুকু বিশ্বাস যে দিয়েছে ভেঙে/ তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই/ সে দিয়েছে আমার/ অন্ধ চোখে আলো/ যার বিশালতার মাঝে/ আমি একটুকু পাইনি ঠাঁই;- গানের মুখড়ার লাইনগুলা কাফি এইটা বোঝার জন্য,- কৃতজ্ঞতা জানাইবার ছলে বিশ্বাসঘাতিনীর প্রতি ঘৃণা ঢেলে দেবেন গায়ক। সে তার অন্ধ চোখে আলো নিয়া আসছিল, এখন চলে যাইতেছে। যাওয়াটাকে তিনি সেলিব্রেট করবেন কী করে! হাসানের সানাইয়ের সুর, খালেদের যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে-র মতো কি নীরব অভিমানে মাইনা নেবেন যাওয়াটা? চাইম-এর খালেদ গানের তরী বাইতে নেমে বরাবর অভিমানী। কণ্ঠে এমন এক সহজাত বিষাদ উনি নিয়া আসত, যার তুল্য কিছু বাংলা ব্যান্ড গান অধিক দেখে নাই। হাসানও অনেকখানি খালেদের মতো অভিমান আর বিষাদে আতুর। খালেদ ও হাসানের রেশ পরে আমরা সঞ্জীব, বেজবাবা সুমন কিংবা আরো পরে মিনারের গানে কমবেশি পাইতে থাকব। তাসনিফ বয়সে সঞ্জীব বা সুমনের জুনিয়র হইলেও অগ্রজদের দেখানো পথে হাঁটেননি। তাঁর এই স্টেপটা (অন্তত আমার কাছে) অন্যরকম মনে হইত তখন।

Cuts Like A Knife by Bryan Adams; Source – Bryan Adams YTC

ব্রায়ান অ্যডামসের কাট লাইফ অ্য নাইফ গানখানা কে না শুনছেন! ব্রায়ান সেখানে তার খসখসে কণ্ঠে প্রেমিকার ছেড়ে যাওয়াকে জাস্টিফাই করতে বইলা ওঠে : Now it cuts like a knife!/ But it feels so right/ Yeah! It cuts like a knife/ Oh, but it feels so right. কেউ তারে চাকু দিয়া ফালাফালা করে দিছে, ফিলটা এখন ব্রায়ান টের পাইতেছে কিন্তু ছিন্নভিন্ন হওয়াটারে ওয়েলকাম জানাইতেছে এমনভাবে, বোঝাই যায়, তার কাছে যাওয়াটা ছিল অপ্রত্যাশিত। গানের ভিত্রে ব্রায়ান শুরু থেকে ক্লিয়ার ছিল,- পাষাণীরে আটকানো যাবে না। এর জন্য নিজেকে দায়ী করতেছে সে। বনিবনাটা জমে ক্ষীর হইতে পারে নাই যেহেতু, তার যাওয়াটা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু ওই যে চলে যাইতেছে, এইটা এখন বেচারা নিতে পারতেছে না। ভালোবাসা হয়তো এ-কারণে এতটা মর্মঘাতী!

তাসনিফের উৎসর্গ এখানে ব্রায়ানস্বরে চলে যাওয়াকে মাইনা নিলেও গানের প্রতিটা চরণে কাউন্টার জারি রাখে সে। কারণটা ওই অন্ধ চোখের উপমায় নিহিত। অন্ধকে যে আলো দিলো, সে যখন আলোটা ফেরত নিয়ে চলে যায় তখন নিজেকে অভিশপ্ত ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না। তার জীবনে এরচেয়ে বড়ো প্রলয় আর নাই। তাসনিফের গায়কি এতটাই নিখাদ… ধাক্কাটা ভিত্রে গিয়া লাগে!

যাই হোক, রোড ৩১-এর আরো একখানা গান সত্য হোক অনলাইনে পাইতেছি। অতিব সুখশ্রাব্য। তাসনিফের নিজস্ব সিগনেচার মার্ক চিনতে অসুবিধা হয় না। রোড ৩১ লেগে থাকলে অনেকদূর যাইতে পারত। আবার দ্রুত একঘেয়ে ও পাইনসা যে হইত না তার গ্যারান্টি নাই। তাসনিফ হয়তো সব ভেবেটেবে সামরিক জীবনে নিজেকে সঁপে দিতে দিরং করেননি। সেখানে তিনি সফল।

Shotto Hok by Tasnif Zaman and Raod-31 Band; Source – Lyrics71 YTC

তাঁর হয়তো মনে হইছে, যে-আলোটা তিনি একজনের বদৌলতে একদিন পাইছিলেন এখন আর সেইটা নাই। আলো নিভে গেছে। কোনো অনুভূতির গভীরে যাওয়া কাজেই তার পক্ষে সম্ভব হইতেছে না। সময় থাকতে অনুভূতির রেশটারে বুকের ভিত্রে গুম করাটা ভালো।

তবে হ্যাঁ, তাঁর একখানা বক্তব্য কোথায় জানি চোখে পড়ছিল, গায়ক সেখানে জানাইছেন,- নিজে না বাঁধলেও তিনি এখনো নিয়মিত গান গান শোনেন। জলপাই পোশাক আর বন্দুকের নলের সঙ্গে উৎসর্গ গানে নিহিত ব্যঞ্জনার কনট্রাস্ট থাকলেও গান শোনার কান তাঁর এখনো জীবিত।
. . .

Utshorgo by Tasnif Zaman and Road-31 Band; Source – Mohammad Abdullah YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 2

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *