দেখা-শোনা-পাঠ

বিধ্বস্ত নীলিমায় সোনালী কাবিন

কোনো বই, বিশেষ করে সেইটা যদি কবিতার বই হয়, এখন এর নামকরণ কি কবির নিকট পৃথক গুরুত্ব নিয়া হাজির হইতে থাকে? বইয়ের ভিত্রে বোঝাই পিঁপড়েসারি অক্ষরগুলাকে কি ডমিনেট করে এই নামকরণ? পিপীলিকাসম অক্ষরে সারিবদ্ধ পল্টুনের সুশৃঙ্খল মার্চপাস্টে ভ্রামণিক কবির মাথায় কি আচম্বিত বইয়ের শিরোনাম ঝিলিক দিয়া যায়? যেসব কবিতা বইয়ে তিনি জায়গা দিলেন, সেগুলার সঙ্গে এই নামের খাতিরানা কেমন? শিরোনামবন্দি বইয়ে সক্রিয় পিঁপড়েসারি অক্ষরের মধ্যে কে কারে নিয়ন্ত্রণ করে তখন,- প্রশ্নটির নির্ণয় ঝকমারি বটে! কথাটা কেন বলতেছি তার কারণ আছে। শামসুর রাহমানের বিধ্বস্ত নীলিমা আর আল মাহমুদের সোনালী কাবিন সহসা ইয়াদ হওয়ায় গোলযোগখান মনে পয়দা হইতেছে।

Samshur Rahman and Al Mamhmud; Image Source – Google Image

বাংলা কবিতায় বই দুখানা সিগনিফিকেন্ট। নিটবর্তী সময়রেখায় প্রকাশিত। রাহমানের সঙ্গে মাহমুদের কাব্যঘরানায় একজরাতা মিল নাই। বিধ্বস্ত নীলিমাসোনালী কাবিন তার বাইরে নয়। মেরুদূরত্ব মেনে বই দুখান লিখছেন তাঁরা। সোনালী কাবিন-এর সনেটগুচ্ছে কবি নিজেকে রিলেট করতেছেন আবহমান বাংলায়। এই বাংলার মধ্যে আবার আজকের বাংলাদেশ সচল আছে। তার উপস্থিতি যদিও সেখানে ম্যাটার করতেছে না। বাংলায় বিচরণের আবেগতাড়িত মুহূর্তে কবি রিকল করতে থাকেন দূরাতীতে জীবিত বাংলাকে। নিজেকে সেখানে তিনি সচল রাখেন। আল মাহমদের এই বাংলাটা প্রকৃত অর্থে নৃতাত্ত্বিক বাংলা। অতীতে তার নাম কী-ছিল বা না-ছিল ইত্যাদি সেখানে বড়ো কোনো মূল্য রাখে না।

সোনালী কাবিন-এ বর্ণিত এই বাংলাটা কৌমশাসিত। দল-গোষ্ঠী-মণ্ডলী হইতে সমাজ-সম্প্রদায় ইত্যাদি পরিচয়ে বিশিষ্ট কৌমের জাত-পরিচয় সুনির্দিষ্ট না। প্রাক-ইতিহাসে সে জীবিত ছিল এবং সেখান থেকে একালপানে বর্ধিত ও বিবর্তিত হইতেছে। মাহমুদ এখন কৌমনিবিড় ভূমিতে বিচরণ করতে গিয়া স্মৃতিজালে বারবার ধরা খাইতেছেন। দ্রোহ, প্রতিরোধ ও মিলনের ছবিগুলা উনার চোখে হানা দিয়া যাইতেছে। কাদামাটিছানা জৈবযৌনতা কবিদেহের শিরা-উপশিরায় তোলপাড় তুলে যাইতেছে। যৌনতাটা প্রাকৃত এবং সে-কারণে তাঁর কাছে স্বাস্থ্যকর। চিত্রী সুলতানের ক্যানভাসে আঁকা বাংলার মতো আদিম পেশল জৈবতা যেখানে দপদপ করে।

সব ঠিক আছে, কিন্তু সোনালী কাবিন নামে বইটারে কী কারণে মলাটবন্দি করলেন আল মাহমুদ? সনেটগুচ্ছে বিবাহ ও বিবিধ উপাচার বর্ণিত বটে, কিন্তু সেগুলা কি কাবিনসম্মত বিবাহরীতির প্রতীক? তার সঙ্গে তো কাবিনের সংযোগ পাইতেছি না! হমায়ুন আজাদের মতো বলতে চাই না,- কাবিনের মতো একখানা মধ্যযুগীয় ঘটনা কী করে সোনালি হইতে পারে! কাবিন অবশ্যই বিবাহসূত্রে সম্পাদিত চুক্তিনামা। বৈবাহিক সংবিধান। আল মাহমুদের মলাটবন্দি বইয়ে যে-প্রাকৃত জীবন অবিরত আওয়াজ তোলে, পীড়ন-প্রতিরোধের বিপরীতে গতরখাকি জৈববাসনা জানান দিতে পিছপা হয় না একরতি,- সেখানে কাবিন এবং তাও সোনালি…! খাপছাড়া কি শোনায় না কানে?

Sonali Kabin by Al Mahmud; Image Source – Google Image

তাইলে কি ধরে নেবো,- কবি আল মাহমুদ নরনারীর প্রাকৃত জৈববাসনায় বিরাজ করতে উতলা, এবং তদ্রুপ নারীদহেকে সম্পত্তি রূপে কাবিনবন্দি করে ঘরে তোলার খায়েশ সনেটগুচ্ছ লেখার সময় থেকে তাঁর মনে পল্লবিত? ঘটনা এমনধারা হলে বইয়ের নামকরণকে মতলবি মানতে হবে। ভবিষ্যতের আল মাহমুদ নিজ বিবর্তনের ছাপ, হইতে পারে অজান্তে, তাঁর এই বহুল পঠিত বইয়ে রেখে যাইতেছেন। কৌম থেকে অতঃপর তাঁকে আমরা কওম-এ বিবর্তিত হইতে দেখছি।

কৌম যদি সুনির্দিষ্ট মানুষ ও সম্প্রদায়কে মিন করার পরিবর্তে সামগ্রিকে ধৃত নৃতাত্ত্বিক বাংলাকে গ্লোরিফাই করে, কওম-এ কি ফ্লেভারটা জারি থাকে অবিকল? সে তো ওই কাবিনজালে বাঁধা! কৌম-নারীদেহ বা তার গতরের বাস নিতে আকুল মাহমুদ নারীকে কাবিনবান্ধা সোনালি ভাবছিলেন তখন। মৃত্তিকাও ছিল কাবিনবান্ধা সোনালি। কওম-এ আসার পথে সে বাস্তবিক সোনালি ছাড়া অন্য কিছু না। তো এই জায়গা থেকে বলা যাইতে পারে,- আল মাহমুদের ম্যাগনাম ওপাসের শিরোনাম ও তার ভিত্রে বিচ্ছুরিত দীপ্তি এক জিনিস নয়। তারা একে অন্যের সঙ্গে কন্ট্রাডিক্ট করে। সোনালী কাবিন না দিয়া অন্য নাম উনি বোধহয় দিতে পারতেন।

যেহেতু দেন নাই, পাঠক ধইরা নিতে বাধ্য,- ওই সময়ে বামনিষ্ঠ মাহমুদের মনোবীজে কৌম থেকে কওম-এর গণ্ডিবদ্ধ পরিসরে যাত্রার ভাববীজ বপন হইতেছিল। বখতিয়ারের ঘোড়ায় এসে সেইটা উনি ডিক্লেয়ার করলেন। সেই মুহূর্ত থেকে বাংলার সঙ্গে উনার সংযোগ ইতিহাসের একটি কালপর্বে নির্দিষ্ট করলেন কবি। বাংলার পরিবর্তে অবিরত ফেরত যাইতে থাকলেন ইতিহাসের নির্দিষ্ট এক কালসীমানায়। মুসলমানি বাংলা বইলা যারে অনেকে এখন পুকার যাইতে ভালা পান। বাংলা সেখানে কৌমনিবিড় আদিমতায় নিজের জৈবতাকে দেখতে নাচার। কাজেই সোনালী কাবিন-এর ভিত্রে বহমান কবিতার সঙ্গে বইয়ের নামকরণের সম্পর্ক ক্ষীণ। আশ্চর্য সনেটগুচ্ছ নয় বরং নামকরণটা এখানে নির্ধারণ করতেছে ব্যক্তি আল মাহমুদের ভবিষ্যৎ। যিনি কৌম থেকে কওমের কাবিনে নিজেকে বিবাহ দিতে মনস্থির করছিলেন।

Biddhosto Nilima by Samsur Rahman; Image Soure – Google Image

অন্যদিকে শামসুর রাহমানের বিধ্বস্ত নীলিমায় বাংলা বা বাংলাদেশকে কি পাইতেছি ব্যাপক? হ্যাঁ পাইতেছি, কিন্তু সেগুলা স্থানিকতায় নিকানো কাঁচা মাটির মতো ধক করে নাকে ঢোকে না। মলাটবন্দি বইয়ে রাহমান যেন-বা বিরাজ করেন খোয়াবঘোর তাকলাগা শহর। শহরটির নামপরিচয় অস্পষ্ট। বাংলার স্থানিকতা সেখানে পেশল ও পাশব নয়। ওইটা হাইব্রিড। রাহমান স্বয়ং তাই বটে। উনার দেহ ও জৈববাসনা স্থানাতীত দুঃস্বপ্নে নিরুদ্দেশ নিতে আকুল দেখি সারাখন। তার মধ্যেই ধরা পড়তেছে ছোটছোট অনুষঙ্গরা। এর কিয়দংশ হয়তো বাংলার কোনো নগর বা শহর মনে করায়, বাকিটা বৃহদাংশে বৈদেশি বইলা ভ্রম হয়। যে-নীলিমাকে উনি কবিতায় বিধ্বস্ত দেখতেছেন সেইটা নিয়া অগত্যা দ্বন্দ্ব দূর হয় না। এই নীলিমা কোন নীলিমা? কোন সে-আসমান এইটা, যার নিচে বহমান জীবনের তুচ্ছ খুঁটিনাটি কবিতায় ধরতেছেন কবি! পুরান ঢাকার ফ্লেভার খানিক নাকে লাগে। নয়া ঢাকার আশপাশে তখনো গ্রামীণ শহরতলির বাস আতকা নাকে ধাক্কা দিয়া যায়। তথাপি ফ্রেমখানা ঢাকা বা বাংলার নগর যেন-বা নয়। বৈদেশিক নগর অথবা শহরতলিকে সে অবিরত ইয়াদ বিলায়।

রাহমানের ক্যারেক্টারগুলা তার ভিত্রে নড়েচড়ে। সোনালী কাবিন-এ ক্যারেক্টার বলতে কবি স্বয়ং। বাদবাকি যা-কিছু সেখানে পাইতেছি, তার সবটা কবিসঙ্গে বিজড়িত। তাঁকে কাবিনে বাঁধতে মরিয়া। বিধ্বস্ত নীলিমায় ক্যারেক্টার ও অনুষঙ্গরা আপাত স্বাধীন। তারা স্বেচ্ছামর্বিড। একই সময়রেখায় দুইটা ভিন্ন ট্রিটমেন্ট আমরা পাইতেছি। একটা লোকালিটির রংয়ে সয়লাব। অন্যটা তখনো যে-নাগরিকতা আমাদের এখানে আসে নাই, যার মধ্যে আমরা তখনো বিলং করতে প্রস্তুত না, এখন সেই নাগরিকতাকে কবি ধরতে উন্মুখ বোধ করতেছেন। রাহমান ওইসব অনুষঙ্গ বিধ্বস্ত নীলিমায় জায়গা দিলেন যেগুলা এখনকার নয়, আগামীর বাংলাদেশে প্রযোজ্য বলা যাইতে পারত। ফলত বিধ্বস্ত নীলিমা শিরোনামখানা কবিতার ভিত্রে সম্পর্ক রেখে অগ্রসর বা সেখান হইতে পয়দা হইলেও,- এইটা এমন এক নীলিমা যার দেখা বাংলায় নয় বরং অন্যত্র মিলছিল তখন।
. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *