কোনো রাজনৈতিক নেতা যখন সকল সীমানা ছাপিয়ে অতিকায় হইতে থাকেন, তার ভক্ত এবং শত্রু পাশাপাশি তৈরি হয়। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সেরকম চরিত্র। স্বাধীন ভূখণ্ডের আত্ম-বিকাশের ইতিহাসে তিনি একমাত্র কেউ না, মাওলানা ভাসানীসহ আরো অনেকের অবদান আছে সেখানে, তথাপি তিনিই একচ্ছত্র সম্রাট। ফেরাউনের সাম্রাজ্যে রিফুজির জীবনে পতিত ইহুদির হৃদয়ে নিজ ভূখণ্ডের বীজ অকাট্য করে তুলছিলেন মুসা নবি। কুড়ি লক্ষ ইহুদিকে মিশর থেকে বেরিয়ে উনার সঙ্গে অনিশ্চিত যাত্রায় শরিক করা পাহাড় ঠেলার সমান ছিল। অসামান্য কাজটা মুসা সমাধা করছিলেন তখন। ঈশ্বর-প্রতিশ্রুত ভূমিতে পৌঁছাইতে চল্লিশ বছর সময় লাগছিল তাঁর। মুসা তবু সেই ভূমিতে পা রাখতে পারেন নাই। নোবো পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে বলছিলেন,- ওই যে দেখা যাইতেছে… দূরে… ওইটা হইতেছে প্রতিশ্রুতি ভূমি। ইহুদির নিজের দেশ। চল্লিশ বছরের যাত্রায় সন্দেহ, অবিশ্বাস, দোষারোপ, অবাধ্যতার সবটাই মুসা ও তাঁর ভাই হারুনকে সইতে হইছিল। হার মানেন নাই। বঙ্গবন্ধুর দেশ প্রাপ্তির লড়াই এদিক থেকে মুসার সঙ্গে মিলে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী আমরা যখন পাঠ যাই তখন একটা মানুষের বুকের ভিত্রে ঘুমন্ত স্বাধীন ভূমির খোয়াব টের পাইতে অসুবিধা হয় না। বাঙালির নিজস্ব ভূখণ্ড হবে একদিন;- এই খোয়াব দেখানোর জন্য শেখ মুজিবের বড্ডো প্রয়োজন ছিল। বাকিরা বিরাট নেতা হইতে পারেন, প্রভাববিস্তারী হইতে পারেন, কিন্তু শেখ মুজিব একজনই আসছিলেন ওইসময়। মুজিব এইটা বিশ্বাস করতেন,- তিনি ও বাঙালি সমার্থক। বাঙালির একটা অংশ তো উনাকে তখনো ভালোবাসতে পারে নাই। তাদের কাছে তিনি নিন্দিত ছিলেন। দেশের ষোল আনার পনেরো আনা মানুষ কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো বিশ্বাস করত :- মুজিব মানে আর কিছু না/ মুজিব মানে মুক্তি;/ পিতার সাথে সন্তানের ঐ/ না-লেখা প্রেমচুক্তি। তুঙ্গ সেই দিনগুলায় মুজিবের শত্রুর কমতি ছিল না। যতটা ভালোবাসা তিনি কুড়াইছিলেন, ততধিক ঘৃণাও নিতে হইছে বুক পেতে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পুরো লগ্ন জুড়ে বাঙালির বৃহৎ অংশের সঙ্গে শেখ মুজিবের সম্পর্ক ওই না-লেখা প্রেমচুক্তির মতো তবু অটল থেকেছে। এর মোরাল স্পিরিট যারা বুঝে না তারা পাঁঠা। যেমন ফরহাদ মজহার বা বদরুদ্দীন উমরের মতো লোকগুলা। ওইটা ছাড়া দেশ স্বাধীন হইত না। কাজেই স্বাধীন ভূখণ্ড আদায় করে নেওয়ার প্রশ্নে শেখ মুজিব একক। তিনি একচ্ছত্র। এমন এক নির্মম স্বৈরাচার, যাকে ছেঁটে দিলে একাত্তরের কিসসু বাকি থাকে না! শত ভাসানী দিয়া ওইটা পূরণ হবে না। মুজিব একা যা হইতে পারছিলেন সেইসময় তার তুল্য কিছু জোটানো কঠিন।
ওরিয়ানা ফাল্লাচির কাছে মুজিবকে মনে হইছিল ফ্যাসিস্ট। হওয়া স্বাভাবিক। উনার মানসগঠন ও সাক্ষাৎকার নেওয়ার ধরন কদাপি বিতর্কমুক্ত ছিল না। মুজিবের ব্যাপারে উনি যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তখন, যাদের সঙ্গে উনার সংযোগ ও আলাপ, এবং উনার উগ্র নারীবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিষয়ে বদ্ধমূল ধারণা… এসব বিবেচনায় নিলে মুজিব সম্পর্কে উনার পর্যবেক্ষণ তীক্ষ্ম হলেও এর কতটা সত্য আর কতটা সেকালের ক্লিবেইট এইটা নিয়া সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাইতেছে। মুজিব ক্যান উনার সামনে আমিই বাংলাদেশ বইলা জাঁক করছিলেন সেইটা ফাল্লাচির বোঝার কথা নয়। কারণ তিনি ভিক্ষাজীবী এই চাচা মিয়াদের জানতেন না। তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব না, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কিচ্ছু পায় নাই, উল্টা মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও ভিক্ষা করে খাইতেছে, তবু এই লোকের কাছে এখনো মুজিব মানে বাংলাদেশ! দুর্বোধ্য এই অন্ধভক্তির নির্ণয় করা মুশকিল। মুজিবকে যা মিথে পরিণত করছে। এমন এক মিথ যার আয়ু সহজে নিঃশেষ হওয়ার নয়।
এরকম অনেক আছেন যাদের কাছে মুজিব এমন এক স্বপ্ন, এমন একখান প্রতীক, এমতো এক বিশ্বাস… যার সমতুল কিছু বিশ্বের ইতিহাসে দুর্লভ। এই মিথ যতদিন জিন্দা ততদিন মুজিবকে ধসানোর পাল্টা মিথ টিকবে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি কি শেখ মুজিবকে ভালোবাসি? না, বাসি না। উনার প্রতি আমার প্রেম ভক্তের নয়। আমি উনার ভক্ত নই। ছিলাম না কখনো। উনার বিরুদ্ধে অনেক রাগ আছে আমার। আছে সুতীব্র ক্ষোভ। তথাপি দিনশেষে আমার কাছেও উনিই বাংলাদেশ।
খোন্দকার মোশতাকের মতো পল্টিবাজরা এখন যতই বাকশালের দায় ঘাড়ে চাপিয়ে তাঁকে খলনায়ক বানাক, যত হাজারে-বিজারে বয়ান তৈরি করুক, এসব নিয়ে যত হাজার তর্কের ফুলকি ছোটাক, তথাপি শেখ মুজিব এমন এক চরিত্র যাঁকে ছেটে ফেলার চেষ্টা বালি বাঁধের মতো ধসে যেত বাধ্য। মুজিব এই দুখী বাংলায় এমন এক স্বাপ্নিক, এমন এক চারণকবি, যাঁরে অপমানিত হইতে দেখলে আজো বুকে লাগে। অন্তরে ক্রোধের ফুলকি লেলিহান হইতে থাকে। ৩২ নাম্বার ছারখার হইতেছে দেখলে হাহাকারে অন্তর বিদীর্ণ হয়। তখন মনে থাকে না উনার বৃহৎ সব ভুল। সফলতার সঙ্গে অগাধ ব্যর্থতা। তিনি তখন সেই মিথ হইতে থাকেন যেইটা কেউ কখনো হয় নাই, হইতেও পারবে না।
মুজিব কেন নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মীমাংসার পথে হাঁটলেন না বইলা যারা জাতিকে সবক শেখান, উনারা ভুলে যান হয়তো, প্রতিটি জাতির মুক্তির গান আলাদা হয়। তার ধরন আলাদা, গড়ন আলাদা, থিতু হওয়ার লড়াইটা পৃথক। শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় এতটাই অভিন্ন, পরস্পরের ভিত্রে লীন… শত হাজার বদরুদ্দীন উমর আর ফরহাদ মজহার এইটাকে শত-শত বয়ান হাজির করেও ভাঙতে পারবে না। কিছু মিথ, তার অগাধ সাফল্য ও ব্যর্থতার গল্প নিয়া চীনের প্রাচীর। শেখ মুজিব নামের লেলিহান সে-মিথের কাছে উমর-মজহারদের বড়ো বেশি সামান্য, বড়ো তুচ্ছ কীট মনে হয়। তারা এবং তাদের দোসর যারা আছে, কারো সাধ্য নাই সে-মিথ ধসিয়ে দেবে! যদি ধসে কোনোদিন তাহলে সে এক অন্য বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে আমি চিনি না। চিনতেও চাই না।
. . .
. . .