শর্ট ইন্ট্রো : দর্শন-চিন্তক ও গবেষক জোশুয়া দিপাওলো (Joshua DiPaolo) বিরচিত দ্য ওরিজিন অব বিলিফ রচনাটি, আমাদের বিবেচনায়, বিবিধ কারণে সময়-প্রাসঙ্গিক। দেশে সম্প্রতি যে-পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার নিরিখে বিশ্বাসের উৎস ও তাৎপর্য নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তাভাবনা করা ও আলাপে গমনের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের নেটালাপে বাংলা ভাষান্তরে রচনাটি পেশ করেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ। রচনায় জোশুয়া যা বলেছেন তার সারার্থকে কেন্দ্র করে তাৎক্ষণিক আলাপ ও পাঠমন্তব্যে অংশ নিয়েছিলেন বাকিরা। সময়-প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টি আমলে নিয়ে আসুন ভাবি বিভাগে দুই কিস্তিতে এর ভাষান্তরসহ পাঠমন্তব্য আপলোড করছি আমরা। আগ্রহী পাঠক রচনাটি পাঠ ও পাঠমন্তব্য সংযোজন করবেন আশা করি।
. . .
অনুবাদকের মুখবন্ধ : জোশুয়া দিপাওলো রচিত দ্য অরিজিন অব বিলিফ তাঁর ইনডকট্রিনেশন অ্যাংজাইটি অ্যান্ড এটিওলজি অব বিলিফ নামক পুস্তিকাংশ থেকে আমি বেছে নিয়েছি। বিখ্যাত দর্শন বিষয়ক জার্নাল সিনথেস-এ এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। মতাদর্শকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধি পেতে থাকা গোঁড়া মনোভাব মানবসভ্যতায় যেসব বিপর্যয় ডেকে আনে, লেখায় তার ওপর আলো ফেলার চেষ্টা করেছেন জোশুয়া। সকল প্রকার মতাদর্শিক গোঁড়ামির সমালোচনা হিসেবে রচনাটিকে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। সমালোচনার পাশাপাশি মতাদর্শিক গোঁড়ামিকে চ্যালেঞ্জ জানানো ও এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলে দিতে চেষ্টা করেছেন তিনি।
দ্য অরিজিন অব বিলিফ-এর মূল ভাব দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। একটি হচ্ছে এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জেস (Etiological challenges) এবং অন্যটি হলো ইনডকট্রিনেশন (Indoctrination)। এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ বলতে এখানে এমন বিষয়কে বোঝানো হয়েছে যেটি গোঁড়া মতাদর্শকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছে ও সন্দেহ জারি রাখছে। প্রশ্ন ও সংশয় জারি থাকার ফলে মতাদর্শকে কেন্দ্র করে পরিপুষ্ট বিশ্বাস বা মানব-সমাজে তার অভিঘাত সংগতকারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। মতাদর্শিক গোঁড়ামির আবেদন তখন আর জোরালো থাকে না। প্রশ্ন, সংশয়, তর্ক-বিতর্কের চাপে গোঁড়া মতাদর্শ নিজের আবেদন হারায় বা ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। জটিল নানা কার্যকারণ ও সীমাবদ্ধতা দোষে দার্শনিকমহলে এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ-এ নিহিত চিন্তন-পদ্ধতি প্রভাববিস্তারী হতে পারেনি। মতাদর্শিক গোঁড়ামিকে প্রশ্নবিদ্ধ ও সন্দেহের বিষয় করে তোলার ঘটনায় তথাপি এর আবেদন এখনো অমলিন।
এটিওলজি কেবল দর্শন বা চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহৃত পরিভাষা নয়। অন্যান্য শাস্ত্রেও এর প্রয়োগ চোখে পড়ে। বাংলায় তার সঠিক পরিভাষা কী হতে পারে সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। ভারতীয় দর্শনে কার্যকারণ বলতে আমরা যেটি বুঝে থাকি, তার কাছাকাছি পরিভাষা হয়তো ভাবা যেতে পারত। উপযুক্ত পরিভাষা খুঁজে না-পেয়ে অগত্যা এটিওলজিতে স্থির থাকা সমীচীন মনে করেছি। অন্যদিকে ইনডকট্রিনেশন শব্দের বাংলা পরিভাষা বোঝাতে মতাদর্শ শব্দটি আমি বেছে নিয়েছি। জোশুয়া অবশ্য় প্রচণ্ড গোঁড়া ও সমাজের জন্য অশুভ বা নেতিবাচক কিছু বোঝাতে শব্দটি লেখায় ব্যবহার করেছেন।
বাংলা ভাষান্তরে আমার নিজস্ব সীমাবদ্ধতার কারণে আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মূল রচনার লিংক অগত্যা জুড়ে দিয়েছি। ভাষান্তরে ত্রুটি-বিচ্যুতির দায় একান্ত আমার। পাঠক আশা করি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন এবং সমস্যাগুলো ধরিয়েও দেবেন, যেন পরবর্তী কোনো তর্জমায় আরো সতর্ক ও যত্নশীল হতে পারি। সকলের পাঠশরিকানা ও মতামত আশা করি।
. . .
বিশ্বাসের উৎস : জোশুয়া দিপাওলো
মানুষ কখনো-কখানো অন্যের বিশ্বাসকে সমালোচনা করে, তারা দাবি করে,- তাদের বেড়ে উঠার ধারা ভিন্ন হলে বিশ্বাসটাও ভিন্ন হতো। যেমন তারা বলে থাকে,- আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, কারণ একটি খ্রিস্টান পরিবারে আপনি পয়দা হইছেন। অথবা,- আপনি লেবার পার্টিকে সাপোর্ট করতেন না, যদি আপনার পরিবারের ওপর শ্রমিক সংগঠনের প্রভাব না থাকত। এই ধরনের সমালোচনাকে সাথারণত এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ বা পয়দায়েশ বা কার্যকারণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে এরকম কিছু বলা যেতে পারে। প্রত্যেকে যা বিশ্বাস করেন তার নির্দিষ্ট ইতিহাস রয়েছে, যেটি আবার নির্দিষ্ট কারণের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। কিছু অভিজ্ঞতা আপনি অর্জন করেছেন, স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসা করেছেন, অন্য লোকজন থেকে প্রমাণাদি যোগাড় করেছেন, বিগ থটস… এরকম বিষয়বস্তু নিয়ে অল্পবিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন, আর এভাবে একটি বিশ্বাসে উপনীত হয়েছেন আপনি। এটিওলজিক্যাল বা পয়দায়েশ সূত্রে পাওয়া চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্বাসের এসব উৎস সম্পর্কে এমন কিছু বাস্তব আভাস নিয়ে আসে- আপনার বিশ্বাসকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ বা সমস্যার মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।
এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ সমূহ সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজে নানা মতলব হাসিলের ভাবনা থেকে সক্রিয় হতে পারে। তার একটি হচ্ছে,- বুদ্ধিবৃত্তিক নম্রতার বাতাবরণ তৈরি করা। উগ্র ধার্মিক বা রাজনীতি-বেহুঁশ উন্মাদরা ভাবে,- তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যারা প্রত্যাখান করছে তাদের সবাই বোকাটে আর একগুয়ে লোকজন। জন স্টুয়ার্ট মিল এরকম লোকজনের ব্যাপারে নালিশ ঠুকতে যেয়ে বলেছিলেন,- এটি তাকে কখনো চিন্তায় ফেলে না যে কেবল একটি দুর্ঘটনা ঠিক করে দিয়েছে বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত কোন ব্যবস্থা তার বেলায় খাটছে। যে-কারণটি তাকে লন্ডন শহরের কোনো গির্জার পুরোহিত বানিয়েছে, একই কারণে বৌদ্ধ ধর্মে মাথা মোড়ানো অথবা কনফুসিয়াসের অনুসারী কিন্তু সে হতেও পারত। এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ কাজেই ব্যাক্তির মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বিশেষ উৎকণ্ঠা তৈরিতে ভূমিকা রাখে বৈকি। লোকজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়,- ভিন্ন পরিবেশে জন্ম নিলে তারা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হতো। এমনকি কেউ যদি নিরলসভাবে নিজের বিশ্বাসের জায়গাজমি তালাশে নামে, এখন এই পটভূমিতে এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জরা একরোখা কোনো উগ্রবাদীকেও অন্যের ভুলভ্রান্তি নম্রতার সঙ্গে আমলে নিতে বলবে।
বুদ্ধিবৃত্তিক নম্রতা বহুপ্রজ আদর্শ। এটি ততটাই ভালো, যত বেশি সম্প্রসারণ ঘটছে তার। এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ দাবি করে,- নিজের বিশ্বাসকে অন্যরা পুনরায় বিবেচনা করুক। কেউ যখন একজন বিশ্বাসীকে বলে,- আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, কারণ একটি খ্রিস্টান পরিবারে আপনি পয়দা হইছেন। এটি তখন কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক নম্রতা সৃষ্টির আহবান নয়, একইসঙ্গে ঈশ্বর বিশ্বাসের বিপরীত কারণ জন্ম দিয়ে বসে।
প্রশ্ন ওঠে,- বিশ্বাসের উৎস ও কারণকে বিবেচনায় নিতে গিয়ে আপনি নিজে যা-বিশ্বাস করেন সেটি বদলে ফেলার প্রয়োজন আছে কি? বিষয়টি এরকম কোনো সত্য নয় যে, আপনি হরহামেশা ভুল করছেন। এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জের সঙ্গে বোঝাপড়া না করেও ভুলের সম্ভাবনা বিষয়ে আপনার পক্ষে সজাগ থাকা সম্ভব। সুতরাং এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিছক একটি পথ;- বিশ্বাসের পেছনে সক্রিয় যুক্তির ওপর সে কোনো স্বতন্ত্র প্রভাব ফেলে না।
হতে পারে,- এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ আপনাকে ইয়াদ বিলায়,- কিছু মানুষ আছেন যারা আন্তরিক,- বুদ্ধিদীপ্ত ও জ্ঞানী,- ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠার কারণে তাদের বিশ্বাসে ভিন্নতা দেখি আমরা। একটি এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ আপনাকে আপনার বিশ্বাসের বিপরীতে আরো যত বিশ্বাস রয়েছে সেগুলোর আপাত যৌক্তিকতা মেনে নিতে বাধ্য করে; সংগতকারণে আপনার নিজস্ব বিশ্বাসের ওপর আস্থা কমিয়ে আনাটা জরুরি হয় তখন। বড়ো কথা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দর্শন-চিন্তক এই মতামতে উপনীত হচ্ছেন। এটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ কিন্তু নিজ থেকে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। নিজের বিশ্বাসগুলো পুনরায় খতিয়ে দেখার পরোক্ষ কারণ যোগান দিতে পারে সে। যদিও সাধারণ বিষয়-আশয়ের দিকে মূলত আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করে,- যেগুলো আপনি নিজের বিচার-বিবেচনায় বরাবর অন্তর্ভুক্ত করে এসেছেন বা করাটা আপনার ক্ষেত্রে উচিত ছিল বটে।
এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জের যৌক্তিক দুটি ব্যাখ্যার মধ্যে এটিওলজি কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৃশ্যপট থেকে খারিজ হয়ে যায়। যে-কারণে আমরা ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা হাজির করব,- এটিওলজিকে যেটি কেন্দ্রীয় বিষয় করে তোলে। আমরা মনে করি, এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ প্রায়োগিক জ্ঞানতত্ত্বের পাশাপাশি মতাদর্শিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। মতাদর্শ বা গোঁড়ামি বস্তুটা কী এবং শিক্ষাপ্রণালী থেকে সে কীভাবে পৃথক তার ব্যাপারে সঠিক কিছু বলা কঠিন। একটি সিদ্ধান্তমূলক সংজ্ঞার চেয়ে আমরা বরং মতাদর্শের খসড়া চরিত্রায়ন প্রস্তাব করি। আমরা মনে করি,- এটি হলো শিক্ষার এমন এক পদ্ধতি যার মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্যবস্থার প্রতি কঠোর প্রতিশ্রুতি ধরে রাখা। এই ধাঁচের পদ্ধতিতে উক্ত প্রতিশ্রুতিগুলো ব্যাপারে বিশ্বাসীদের সন্দেহ পোষণ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। প্রবৃত্তিগতভাবে নানা ভাগে বিভক্ত লোকজনের মনে বিশ্বাস জারি রাখতে প্রতিশ্রুতিগুলোর ব্যবহার ঘটে থাকে, এবং যারা সেগুলোকে অস্বীকার করছে, এখন তাদের কথায় কান না দিতে উৎসাহিত করা হয়। প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করাকে সেক্ষেত্রে পাপ হিসেবে (যেমন অবিশ্বাস) গণ্য করা, এবং নেতিবাচক অনুভূতির সঙ্গে (যেমন ভয়) যুক্ত থাকতে বাধ্য করা হয়। প্রতিশ্রুতি গিলানো ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুণাবলী আর ইতিবাচক সব অনুভূতির সঙ্গে মানুষকে যুক্ত রাখার মতলবে তারা এসব করে থাকে।
মতাদর্শকে সর্বজন সমর্থিত অথবা সেটি কিসসু নয় বলে খারিজ করা উচিত নয়। আমাদের অভিমত হচ্ছে, শিখন প্রক্রিয়ায় এসব পদ্ধতিকে মতাদর্শিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখাটাই যথাযথ। এসব কারণে মতাদর্শ বা গোঁড়ামিকে স্বাভাবিক নিয়মে উত্তম শিক্ষার বিপরীত কিছু বলে ভাবা যেতে পারে। উত্তম শিক্ষা যেখানে শিক্ষানবিশকে যৌক্তিক চিন্তা উপহার দেয়, মতাদর্শ বা গোঁড়ামি সেই ক্ষমতাকে এড়িয়ে যাওয়ার তালে থাকে, যার ফলে শিক্ষানবিশের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমাদের কথা হলো, একজন ব্যক্তিকে অনেকক্ষেত্রে এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ প্রদানের সময় তাকে বোঝানো হয়,- তার বিশ্বাসগুলো মতাদর্শ ধারণ করছে এরকম পণ্য ছাড়া কিছু নয়;- মানে দাঁড়াচ্ছে, তাকে সেগুলোর ওপর আস্থা হ্রাস করতে বলা হচ্ছে সেখানে। যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নেই, সে স্বীকার করে যে সে একটি মতাদর্শের অধীন। কী কারণে এটি তার মন পরিবর্তনে তাকে বাধ্য করবে? এরকম ভাবা অযৌক্তিক,- বিশ্বাস অর্জনের কোনো একটি পদ্ধতি বেছে নেওয়ার মাধ্যমে আপনি সত্যিকার বিশ্বাস অর্জনের বরাত লাভ করেছেন;- আদতে এটি আপনাকে মিথ্যা উপহার দিচ্ছে। আমরা যে-বিশ্বে বসবাস করি সেখানে সকলে স্বীকার করবেন,- যৌক্তিক প্রয়োজনের বিষয় হিসেবে নয় বরং আনুষাঙ্গিক সত্যের ধারক হিসেবে মতাদর্শগুলো সচরাচর মিথ্যা বিশ্বাস সরবরাহ করে থাকে। এমনকি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শে জড়িতরা মতামত প্রদানে ওইসব মতাদর্শ ব্যবহার করেন।
ক্যাথলিকরা যেমন ভাবে,- তাদের শিশুকে ক্যাথলিক বিশ্বাসে দীক্ষিত করায় তারা সত্যের নিকটবর্তী হয়েছে। সেই তারাই আবার ভাবে,- পৃথিবীতে আরো যত শিশু রয়েছে, যারা ইসলাম অথবা নাস্তিক বা অন্য মতাদর্শের অধীন,- তারা মিথ্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আপনি যে-ধর্মে বিশ্বাস করুন-না-কেন, আপনাকে ভাবতে হচ্ছে,- অন্য মতাদর্শে বিশ্বাসী বিরাট সংখ্যক মানুষ মিথ্যার অনুসারী। এবং আপনি যখন আপনার বিশ্বাসকে মতাদর্শ বহন করছে এরকম পণ্য হিসেবে দেখেন, তখন এই স্বীকৃতি আপনাকে সত্য হিসেবে আমলে নেওয়ার ঘটনায় বাকিদের আস্থা হ্রাস পাওয়ার কারণ হয়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে আপনি এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জের ফলে আপনার বিশ্বাসকে মতাদর্শিক পণ্য হিসেবে দেখতে পারেন? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো,- কার্যকর মতাদর্শরা নিজস্ব পদ্ধতিতে নিজেকে আবৃত রাখে। মতাদর্শ সনাক্ত করার ক্ষেত্রে শতভাগ নির্ভুল কোনো পদ্ধতি নেই। তবে কিছু পদ্ধতি অন্যগুলোর চেয়ে অধিক কার্যকর হতে পারে। আপনার মানসিক জীবন সম্পর্কে একটি সাধারণ আত্মবিশ্লেষণ আপনাকে অনেকদূর নিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে রয়েছে ব্যাপক অনুসন্ধান, যেটি সামাজিক ক্ষেত্র থেকে আপনি আহরণ করতে পারেন। যেমন আপনার বন্ধু, পরিবার ও শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা,- আপনি যা-কিছু শিখেছেন তার ইতিহাস কি তাদের মনে আছে? এটি একটি ভালো শুরু হতে পারে।
একইসঙ্গে এখনো অপরিচিত সম্প্রদায়ের কাছে নিজেকে আপনি প্রকাশিত হতে দিতে পারেন;- এর ফলে শিক্ষার বৈচিত্র্যকে আপনি আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন, যেটি আপনার শিখন প্রক্রিয়ায় নিহিত সংকীর্ণতা চিনতে সাহায্য করবে, এর পাশাপাশি শিখনের বৈচিত্র্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণাও আপনি পাবেন। কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দূরত্ব কাজে দিতে পারে, যখন আপনি ভৌগোলিক কারণে আপনার মতাদর্শ বহনের জন্য দায়ী সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে আসবেন। অ্যালেন বুকাননের কথা আমরা বলতে পারি। বুকানন যে-সম্প্রদায়ে বেড়ে উঠেছিলেন তারা বর্ণবাদী মনোভাব পোষণ করতেন। তাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার পরেই কেবল বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলেন।
আমি আটারো বছর বযসে এই বিষাক্ত সামাজিক পরিবেশ ত্যাগ করেছিলাম, এবং বুঝতে পেরেছিলাম,- বর্ণবাদের ক্ষেত্রে যে-বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আমি পোষণ করে এসেছি সেটি কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গের মধ্যে প্রকৃতিসুলভ পার্থক্যকে বানোয়াট বিশ্বাস তৈরির জাল হিসেবে ব্যবহার করছে। আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল প্রতারিত হওয়ার তিক্ত অনুভূতি। আমি যাদের বিশ্বাস করতাম এবং তাদের দিকে তাকাতাম,- আমার বাবা-মা, খালা-চাচা, যাজক ও শিক্ষক, এবং স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা,- তারা কেউ সত্য নয়, বরং বিপজ্জনক ত্রুটির উৎস ছিলেন।
ধর্ম এবং নৈতিকতা সম্পর্কে বিশ্বাস জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে মতাদর্শ সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে, যেহেতু এই ধরণের বিশ্বাসগুলো আমাদের সামাজিক অবস্থানের নিরিখে সংবেদনশীল। এবং সেটি আপেক্ষিকভাবে পক্ষপাতহীন অভিজ্ঞতার দ্বারা পরিচালিত হয় না। তবে এটি বাস্তবিক কার্যকর এরকম একটি বিশ্বাস। অস্বাভাবিক নয় যে, এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জরা সচরাচর এই ধরণের বিশ্বাসকে লক্ষ্যবস্তু করে। আমরা এই বিশ্বাসগুলোর ব্যাপারে চরম সংবেদনশীল, এবং সেখানে ভুলের ফল বিপর্যয়কর হতে বাধ্য। মানব-ইতিহাসের অন্ধকার মুহূর্তগুলির দিকে এক নজর তাকালে শোষণ, ধর্মান্ধতা, অমাবিকতা চোখে পড়ে, স্পষ্ট হয়ে ওঠে,- গোঁড়া মতাদর্শ থেকে উৎপন্ন ফলাফল কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। এটিওলজিক্যাল চ্যালেঞ্জগুলোকে কাজেই সামাজিক হাতিয়ারের একটি হিসাবে উপলব্ধি করা উচিত। নিজেকে ও অন্যকে যতটা সম্ভব সাহায্য করতে, একে অন্যকে বুঝে উঠতে, মোকাবিলা ও সংবেদনশীলতার জন্য, এবং বিপদ-আপদ কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা একে ব্যবহারে সচেষ্ট হতে পারি।
. . .