. . .
আমার এক পাড়াতুতো বন্ধুর দেশ নিয়া পাগলামি আছে। বহুজাতিক কোম্পানিতে বড়ো পদে কাজ করে সে। বিজি লাইফ তার। তার মধ্যেও দেশকে নিয়া ভাবার বাতিক তারে ভোগায় বেশ। দেশের তরুণ প্রজন্মকে কৃষিতে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায় সেই চিন্তা তারে কুরে-কুরে খায়। মাঝেমধ্যে বাতিক এমন চাগার দিয়া ওঠে, আমাদের মতো পুরানা দোস্তদের ইয়াদ করবে সে তখন। কী করা যাইত আর আমরা কী করতেছি এসব কিচ্ছা তখন ঝিম মেরে শুনতে হয়। আমি তার কষ্টের জায়গাটি ধরতে পারি, কিন্তু কিছু তো করার উপায় নাই আর! সে নিজেই কৃষিকাজের বাইরে পড়ে আছে। ঢাকায় থাকে। বড়ো চাকরি আর বউ-বাচ্চা-পরিজন নিয়া থাকে একশো প্যারায়। তার পক্ষে ইচ্ছে করলেও সব ছেড়েছুড়ে আবাদি হওয়া সম্ভব নয়।
যাই হোক, হাসিনা সরকার পড়ে যাওয়ার মাস দুই আগের ঘটনা হবে সেটি। বন্ধুর মাথায় কৃষি পুনরায় ভর করে। মনস্থির করে,- এখন থেকে এসব নিয়া সে নিয়মিত লিখবে। একজনও যদি তাতে অনুপ্রাণিত হয় এবং তার টিপস মেনে আবাদে ফেরত যায়, সেইটা হবে তার জন্য সাকসেস। একজন আরম্ভ করলে দশজন তারে দেখে আগাবে ইত্যাদি। কাজের সুবাদে সারা বাংলাদেশ মোটের ওপর তাকে ঘুরতে হয়। কৃষিজগৎ ও কলকারখানার জগৎ, দুটোর উপ্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা মন্দ নয়। তো নিজের অভিজ্ঞতা সে লিখল এবং আমারে পাঠাইল দেখে দেওয়ার জন্য। কৃষি ও কৃষকদের নিয়া কী-কী উদ্যোগ সরকার নিতে পারেন, এসব বেশ গুছিয়ে লিখছিল সেখানে। সাহিত্যিক ভাষায় অবশ্যই নয়। তার লেখার বড়ো অংশ জুড়ে ছিল একগুচ্ছ প্রস্তাবনা, যার মধ্যে কয়েকটি বাস্তবসম্মত মনে হইছিল তখন।
লেখায় নিজেকে দেশের রাজনীতি সচেতন নাগরিক বইলা অ্যাড্রেস করছিল সে। নিজেক এভাবে অ্যাড্রেস করাটা মনে দাগ কাটছিল। শেখ হাসিনার পনেরো বছর মেয়াদী শাসনে রাজনীতিসচেতন শব্দটি আমি স্বয়ং ভুলতে বসছিলাম। বাল্যবন্ধুর সুবাদে সেইটা ফেরত আসে দেখে স্মৃতিকাতর হইছিল মন। দোস্তকে ফিডব্যাক দিতে গিয়া মনে হইল,- আমাদের তো বিসমিল্লায় গলদ! প্রথমত আমাদের বাচ্চারা আপাতদৃষ্টে রাজনীতি সচেতন মনে হইলেও তারা আসলে চেতনাহীন। চেতনানাশক দিয়া তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রাখছেন রাষ্ট্র, যদিও তারা সেইটা টের পায় না। নিজেরে সচেতন বইলা ভাবে। এরচেয়ে মারাত্মক,- তারা ভূমিহীন। আমরা নিজে কৃষি থেকে বিচ্ছিন্ন হইতে গিয়া পয়লা ভূমিহীন হইছি, আর আমাদের সন্তান হওয়ার সুবাদে তারাও একই পথের পথিক এখন! ভূমিহীন এই শিক্ষিত প্রজন্ম দিয়া কী হবে? যাদের সঙ্গে সভ্যতার আদি পেশার কোনো সংযোগ অবশিষ্ট নাই!
বন্ধুকে সেসব কথা লিখছিলাম। ফুকুওকার প্রসঙ্গটা সেখানে ছিল মনে পড়ে। বাংলাভাষী কবিলেখকের মধ্যে মণীন্দ্র গুপ্ত আর গায়েন কফিল আহমদ ছাড়া কাউকে এই কৃষিদার্শনিকের কৃষিসাধনা নিয়া গভীর ভাবনা করতে দেখি নাই। পঞ্চব্রীহি ধানের উদ্ভাবক আবেদ চৌধুরীর নিরলস বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়া যেমন ভাবার লোক দেশে নাই এখন। আবেদ যদিও বাংলা কবিতায় ধানের খবর নিতে যথেষ্ট উৎসুক সদা। আমাদের এই আপাত সচেতন চেতনাজীবীদের চেতনানাশক অবস্থায় দিনাতিপাত করার বড়ো কারণ,- আমরা সকলে কমবেশি ভূমিহীন শিক্ষিত প্রজন্ম রূপে বিকশিত হইতেছি। আমাদেরে সঙ্গে মাটির যোগ নাই। খরা ও বৃষ্টির যোগ নাই। বৃক্ষের যোগ নাই। পাখাপাখালি ও ধানখেতের সংযোগ নাই। খনার যোগ নাই। কমল চক্রবর্তীর মতো অতিকায় অরণ্যে পরিণত মানুষটার সঙ্গে যোগ থাকার অবকাশ নাই। যার ফলে আমাদের মনের মাটিতে কখনো বৃষ্টি পড়ে না। এই মন মরুভূমি। খরায় ফাটা মাটি।
আমাদের সাহিত্যিক অধঃপতনের বড়ো কারণ কিন্তু এখানে নিহিত আছে। বাংলাভাষী লেখকের ক্ষমতা নাই হাওরে আফালকে সে বর্ণনা করবে। দিবারাত ও ঋতুবদলের বৈচিত্র্যকে ভাষাচিত্রে ধারণ করবে। নদীর বুকে চর জাগা ও ধসসের নাটকীয় পরিনাম বিষয়ে ফাটিয়ে লেখার মতো বীক্ষণ সেখানে অনুপস্থিত। না আছে সাগরকে বর্ণনা করার হিম্মত। এই দেশে এসব ন্যারেটিভ মোটের ওপর নিখোঁজ। রুশরা যেমন স্তেপকে তাদের সাহিত্যে দুর্দান্তভাবে ধারণ করছেন, ওই মানের বয়ান রচনার সক্ষমতা বাংলাদেশের কবি ও কথাসাহিত্যিকরা অর্জন করতে পারেনি। তিন বন্দ্যোপাধ্যায় এসব নিয়া ন্যারেটিভের যে-ধারা তৈরি করছিলেন, সময়ের সঙ্গে সেখানে নতুন বাঁক আমরা সেভাবে নিতে পারি নাই। ওপার বাংলার লেখকরা তথাপি চেষ্টা করছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষ উনাদেরকে সফল মানতে হইতেছে। বাংলাদেশে সেটুকুও এখন আর জীবিত নাই। গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ জন্ম দিতে পারে এমন লেখকের আকাল আজো তাই মিটেনি।
আমরা না পারতেছি গ্রামীণ জনপদকে বলিষ্ঠ বয়ানে তুলে আনতে, না আজো পারছি নগরজীবনে অবিরত তৈরি হইতে থাকা বিচিত্র রংকে সাহিত্যের ভাষায় বর্ণিল করে তুলতে। ওপার বাংলার সাহিত্য পাঠ করলে তবু কলকাতা মহানগরের অজস্র খুঁটিনাটি অনায়াস মনে গাঁথা হইতে থাকে। আমাদের কথাসাহিত্য ও কবিতায় ঢাকাসহ বাংলাদেশের একটি শহরকে চেনার উপায় নাই। গ্রামীণ জনপদের সুলুক পাইতে অগত্যা ফেরত যাইতে হয় আভা গার্দের ফসল সুলতান নয় কামরুল হাসানের অনুপম চিত্রকলায়। ব্যান্ড গানে কিছুটা ধরা আছে নগরজীবী তরুণ প্রজন্মের সংবেদ। বাদবাকি সবটাই ধু ধু বালুচর!
শিক্ষিত প্রজন্ম সারা বিশ্ব জুড়ে এখন ভূমিহীন। যে-কারণে ফুকুওকা, কমল চক্রবর্তীর খাটা-খাটনি সফল হইতেছে না। নিজের কৃষিদর্শন খোদ জাপানে ফুকুওকা সফল করতে পারেননি। বহুজাতিকের হাতে জিম্মি বিশ্বব্যবস্থায় সেইটা সম্ভব না। হোমিওপ্যাথ আর আয়ুর্বেদের বিকাশকে বহুজাতিকরা প্রতিহত করছে। এ্যালোপেথির স্বার্থে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুটি পৃথক শাখাকে তারা রীতিমতো গ্রাস করছে দানবের মতো। অত্যাধুনিক গবেষণার পথে দেয়াল তুলে রাখা হইছে বহু বছর ধরে। ভেষজবিজ্ঞানকে কুক্ষিগত করে কামসারা বলে তারা বসে থাকেনি। এর যথেচ্ছ ব্যবহার করতেছে এখন।
একই কারণে প্রতিটি জাতির মধ্যে সচল প্রকৃতিবান্ধব কৃষিবিজ্ঞানের হাজারবর্ষী অভিজ্ঞতাকে (আমাদের খনার বচনে নিহিত প্রকৃতিবীক্ষণ) একবাক্যে অবৈজ্ঞানিক বলে খারিজ করে তারা। এখন আবেদ চৌধুরী যতই বোঝান, যতই লড়াই করেন, কে শোনে কার কথা! সমগ্র ছকটির মধ্যে গভীর রাজনীতি ও ব্যবসায়িক রণনীতি কাজ করে বিধায় আধুনিক কৃষিপদ্ধতির সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী কৃষিজ্ঞানের বিনিময়, মিলন ও সংহতির কোনোটাই বিশ্বে জীবিত নাই।
জিনবিজ্ঞানকে প্রকৃতির অনুপাতে গড়ে তোলার পরিবর্তে তারা উল্টা দিকে নিয়ে গেছে। যার পরিণাম গোটা বিশ্ব টের পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। খাদ্য উৎপাদন পর্যাপ্ত অথচ বণ্টনে ভারসাম্য নাই। ধনী দেশের লোকজন প্রয়োজনের তুলনায় ছয় থেকে সাতগুণ অপচয় করে। অয়েলমানির সুবাদে ধনকুবের সৌদি বা কাতারের লোকজন, সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, গরিব কোনো দেশের তুলনায় তেইশ শতাংশের অধিক খাদ্য অপচয় করে। অপচয়ের মাত্রা ঠিক রাখতে অগত্যা একই জমিতে অত্যাধুনিক সব টেকনোলজি দিয়ে অবিরাম উৎপাদন করতে কৃষককে বাধ্য করা হইতেছে।
আমরা উন্নয়নশীল জাতির এই সক্ষমতা নাই নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের মতো করে ভাবব,- কোনটা নিতে পারি আর কোনটা বাদ দেওয়া দরকারি। ধান থেকে অজস্র বীজের জন্ম দিয়েছে বহুজাতিক। ওইসব বীজের জাত থেকে আপনি একশোটা বীজ জন্ম দেন তাতে সমস্যা নাই। আদি বীজ চোখেও দেখবেন না! তার সঙ্গে জন্ম নিয়েছে বীজকে মাটিতে জোর করে ফলবান করে তোলার হাজার কুৎসিত উপায়।
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি মোটের ওপর ওই ধাঁচে তৈরি। আদি বীজ এখন আপনি কই পাবেন? আমরা তো জিম্মি বহুজাতিক আর আন্তর্জাতিক ময়দানে খেলতে নামা প্লেয়ারদের হাতে। ঘুড়ি উড়াইতেছি কিন্তু নাটাই নিজের হাতে নাই। সুতরাং বিশ্বব্যবস্থায় বড়ো (এবং অবশ্যই ইতিবাচক) রাজনৈতিক পালাবদল যদি না ঘটে, সেরকম প্যারাডাইম শিফট না ঘটলে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার সকল চেষ্টা বালির বাঁধের মতো ধসে পড়বে। ফুকুওকা আর কমল চক্রবর্তীর মতো মানুষরা বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম হিসেবে অচিহ্নিত থেকে যাবেন শিক্ষিত ভূমিহীন প্রজন্মের কাছে।
. . .
ফুটনোট : কৃষি এখন সিনেমায় বরং উঠে আসতেছে। আমাদের নয়, তামিল-মালয়ালম সিনেমায়। এখানে সংযুক্ত গানের মালয়ালম ভাষাটা উপেক্ষা যাইতে পারি আমরা। কী বলতেছে সেইটা এম্নিতেও বোঝা যায়। গানটা বাংলার। বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক সেখানে ধান রোপণ করতে গেছে। গানে উঠে আসতেছে যাপনটা।