দেশের হালত যত দেখি,- রিয়েলিটি ও ফিকশনের ধাঁধায় খাবি খায় মন! বিজয়ের মাস ডিসেম্বরকে কবে এতটা নিষ্প্রভ দেখেছি সেটি স্মৃতির অলিন্দ হাতরে মনে করতে পারছি না এখন! আগামীকাল চৌদ্দ ডিসেম্বর। বুদ্ধিজীবী নিধনদিবস। তার একদিন পর বিজয়দিবস। গত পনেরো বছর বা আগেও, এই দুটি দিবসকে যে-মাত্রায় স্মরণ করেছে জাতি, দুইহাজার চব্বিশ সনের ডিসম্বরে তার কিছুই চোখে পড়েনি এখনো। না পড়ারই কথা অবশ্য। দেশের মসনদে যারা বসেছে তাদের কাছে ঊনিশশো একাত্তর কোনো স্বস্তিকর বছর নয়। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন ইয়াদ করার ঠেকা নিয়ে তারা শেখ হাসিনাকে দেশছাড়া করেনি। চব্বিশ দিয়ে একাত্তরকে মুছে দেওয়ার মতলবে ক্ষমতা দখলে নিয়েছে। স্বাধীনতার ইতিহাস ও তাকে কেন্দ্র করে যত বয়ান, তার সবটাই নতুন করে লিখছে তারা। তাদের এই সক্রিয়তাকে প্রতিহত করার মতো পাল্টা বয়ান রচনার সক্ষমতা বা সেই পরিস্থিতি দেশে এখন অনুপস্থিত।
একাত্তরকে যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশের মহেন্দ্রক্ষণ গণ্য করে এসেছেন এতদিন, তারা আজ পরাভূত পাখি। পরাজিত, এবং অবনতও বটে! সন্ত্রস্ত আর দিশেহারা বিলক্ষণ। কেন এই পরিণতি সেটি নিয়ে আলাপের সময় অবশ্য নয় এখন। আলাপটি তথাপি আজ-নয়-কাল তাদেরকে তুলতে হবে। ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বাংলাদেশ, যেখানে রিয়েলিটি অবিরত ফিকশনে বদলে যাচ্ছে, আর ফিকশন পরিণত হচ্ছে নিখাদ বাস্তবতায়। গোলকধাঁধায় বসেই অগত্যা পেছনপানে তাকাতে হচ্ছে পুনরায়। তাকানোটা কেবল সূচনা মাত্র। পরে হয়তো সবিস্তারে খতিয়ে দেখা যাবে কী সেসব ভুল যার ফেরে দেশ আজ দিশেহারা অনিকেত। ছোট্ট এই রচনাকে পাঠক সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমলে নেবেন আশা করি।
. . .
পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ অবধি দাগানো কালপর্বে আমরা একটি বাস্তবতায় বিদ্যমান ছিলাম। বৈষম্য যেখানে সব ছাপিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল। এমন এক বাস্তবতা যার বিরুদ্ধে লড়াই না করে উপায় ছিল না। আমরা লড়েছি। বিনিময়ে স্বাধীন ভূখণ্ড পেলাম। স্বাধীনতার পর সকলে মিলে পা রাখি নতুন বাস্তবতায়। বাস্তবতাটি ছিল ফিকশনাল। আমরা ধরে নিয়েছিলাম,- এখন থেকে স্বাধীন ভূখণ্ডে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সকলে মিলে গড়ব সোনার বাংলা।
ফিকশন তো তৈরি করলাম আমরা। এখন একে গড়ে তোলার রাজনীতি কি সদ্য ভূমিষ্ট ভূখণ্ডে মজুদ ছিল? জাতির আশার বাতিঘর শেখ মুজিব কি ভাবছিলেন তখন? যুদ্ধবিধ্বস্ত ও শতমুখী ষড়যন্ত্রে জেরবার জাহান্নামে বসে তাঁর পক্ষে পুষ্পের হাসি হাসা অবান্তর ছিল। এমন এক ফিকশন দরকারি ছিল, যার ওপর ভর দিয়ে তিনি আগাবেন। দেশ গড়তে সকলকে ডাক দেবেন এক-এক করে। তাঁর নিজের ভাষায় মাল্টিক্লাস পার্টি আওয়ামী লীগকে গড়েপিটে নেবেন নতুন করে। রিয়েলিটি যদিও তখন অন্যভাবে তৈরি হচ্ছিল, যার সঙ্গে একাত্তরের সংযোগ আর নিবিড় ছিল না।
এখন একে মোকাবিলা করার কিফশনে তৈরিতে নিবিষ্ট বঙ্গবন্ধুকে আমরা বিভ্রান্ত দেখছি। বিভ্রান্তি এতটাই মাত্রাছাড়া মোড় নিলো, কবি শামসুর রাহমান স্বয়ং লিখতে বাধ্য হলেন :- নন্দিত সেই নায়ক অমোঘ নিয়তির টানে/ গরীয়ান এক প্রাসাদের মতো বিপুল গেলেন ধসে। তার মানে, ফিকশন তৈরিতে নিবিষ্ট শেখ মুজিবকে স্বয়ং সমাহিত হতে হলো নতুন বাস্তবতায়। মুজিব কেবল নিজে সমাহিত হলেন এমন তো নয়। ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বার বাড়িতে সেদিন যে-সন্ত্রাস রচিত হলো, তার কোপানলে দেশটাই সমাহিত হয়েছিল ঘোর অমানিশায়। মুজিব সমাহিত হলেন অসমাপ্ত ও একা! বাংলাদেশ তো সেই তখন থেকে ফিকশনঘোর বাস্তবতায় খাবি খাচ্ছে।
দায়টা তাহলে কার? শেখ মুজিবের একার? আপামর বাঙালি জনতার? একাত্তরে নতুন ফিকশনকে বাস্তব করবে বলেই না তারা একতায় লীন হয়েছিল! অতঃপর, সেই জনতাকে বিভ্রান্ত, বিভক্ত আর রুষ্ট দেখছি আমরা। যেসব বয়ানকে তারা নয় মাসের জনযুদ্ধে দাপটের সঙ্গে প্রতিহত করল, সেই তারাই আবার ওইসব বয়ানজালে ধরা খেতে সময় নিলো না। মুক্তিযুদ্ধকে যে সময়-সময় অসমাপ্ত বলছিলেন অনেকে, আজ, এই দুইহাজার চব্বিশে, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে তৈরি বয়ানগুলোর ফেরত আসা দেখে সেরকম মনে হচ্ছে বটে!
শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় খান আতাউর রহমান একটি ছবি বানিয়েছিলেন। গুরুসদয় দত্তের গানের কলি থেকে ধার করে ছবির নাম রেখেছিলেন,- আবার তোরা মানুষ হ। সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী অথবা মিতার আলোর মিছিল মর্মান্তিক যেসব ক্ষত ও বলিদানকে সেইসময় গ্লোরিফাই করেছিল, তার থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে ছবিটি তখন বানাচ্ছেন খান আতা। একাত্তর জুড়ে আমরা যেসব যুবাকে জান বলে মেনেছি, ওইসব মুক্তিসেনাকে মানুষ হতে বলছেন তিনি। তাদেরকে ঘিরে সৃষ্ট মিথকে ক্রিটিক করছে খান আতার ছবি। অল্প সময়ের মধ্যে তারা মিথে পরিণত হয়েছিল। খান আতা এখন সেই মিথকে প্রশ্ন করছেন। কেন করছেন? উত্তরে হাসিনা আমলে এসে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু কি বলছেন শুনি। বাচ্চুকে আমরা বলতে শুনছি,- আতা ভাই পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। মুক্তিসংগ্রামকে সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিরোধ করা উনার লক্ষ্য ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অরাজকতা চলছে দেখে সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন… ইত্যাদি।
. . .
খান আতা কী ছিলেন বা না-ছিলেন সেটি পৃথক আলাপের বিষয়। আবার তোরা মানুষ হ-এর মধ্যে এই রিয়েলিটি তো ছিল,- মুক্তিসেনা যুবারা নয় মাসের দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পর আপাতত গন্তব্যহীন। তারা জানে না, এখন তাদের ঠিক কী করা উচিত এবং কোথায় যাবে তারা। সিরাজুল আলম খানরা এই বিন্দুতে এসে প্রিয় মুজিব ভাইকে ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ছাত্রলীগে ভাঙন ধরিয়ে জাসদ গড়ে তুলছেন স্বাধীনতার অন্যতম নেপথ্যকর্মীর একজন।
প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকি নিচ্ছেন সিরাজুল আলম খান। কেন নিচ্ছেন? উত্তরে গেল তেপ্পান্ন বছর ধরে আমাদের শুনতে হয়েছে, তাঁরা বিভ্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন। দেশটাকে ধ্বংস করতে প্রতিবিপ্লবের বয়ান তৈরিতে গমন করেন তখন। যে-সিরাজুল আলম খান গোটা জনযুদ্ধের অন্যতম নিউক্লিয়াস রূপে মুজিব ভাইয়ের কামলা খাটলেন, তাঁকে একবাক্যে দ্য কন্সপিরেটর মার্কিং আমরা দিয়ে দিচ্ছি। একটি ফিকশনের মধ্যে বাতিল করছি তাঁর সকল অবদানকে!
সিরাজুল আলম খান আমাদের কাছে আর মুক্তিযোদ্ধা নেই,- নিছক ষড়যন্ত্রী। ওইসময়কার যুগবিশ্বকে আদৌ আমলে নিচ্ছি না আমরা। শেখ মুজিব কী কারণে সিরাজুল আলম খানদের দেখানো পথে বিপ্লবী হতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কেন তিনি সমাজতন্ত্রকে তাঁদের ছকে পাঠ করতে সদা অনীহা বোধ করতেন, এবং উভয়ের মধ্যে মেরুদূরত্বের নেপথ্যে আর কী-কী উপাদান সক্রিয় থাকতে পারে ইত্যাদি কিন্তু আলাপে এখন আর জায়গা নিতে পারছে না। এই-যে বয়ান ও পাল্টা বয়ানকে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে নাসিরউদ্দিন বাচ্চুরা মোকাবিলা করতে নারাজ থাকলেন,- সর্বনাশের বীজ সেখানেই পোঁতা ছিল। চব্বিশে এসে যেটি ষোলকলায় তার মেয়াদ পূর্ণ করেছে। খোদ শেখ মুজিবকে বাংলাদেশ থেকে মুছে দিতে কার্পণ্য করছে না সে।
সিরাজুল আলম খানদের মতো শত হাজার যুবা তখন ফিকশন থেকে রিয়েলিটিতে আছাড় খেয়ে পড়ছিলেন। গন্তব্যহীন অনিশ্চয়তা ছিল নতুন বাস্তবতা। খান আতা সেখান থেকে তাদেরকে ফিরতে বলছিলেন। উনার এই আহবানকে আমরা নিতে পারিনি। তার বদলে ট্যাগিং দিচ্ছি উনাকে…! খান আতা রাজাকার! রাজাকার যদি হয়েও থাকেন তাঁর প্রশ্নটি তো ভ্যালিড ছিল। আমরা সেটি শুনতে ইচ্ছুক নই বা ছিলাম না কখনো। শালপ্রাংশু মুজিব স্বয়ং অনেককিছু কানে তোলার অবস্থায় ছিলেন না। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই উঠছে না। বিগত তেপ্পান্ন বছরে রিয়েলিটির মধ্যে নতুন রিয়েলিটি এভাবে জন্ম নিয়েছে।
ফিকশনে ভাষা পাওয়া রিয়েলিটি ভেঙে দিতে পাল্টা ফিকশন তৈরি করেছিলেন খান আতা। আমরা তথাপি অচেতন থাকাটা নিরাপদ ভেবেছি। খান আতার ক্রিটিককে আমলে নেওয়ার ঠেকা বোধ করিনি। সহজ পন্থায় তাঁকে মার্কিং করে দিয়েছি। মামলা খালাস। মার্কিংয়ের এই খেলা কি আজো জারি নয়। চব্বিশ এই জায়গায় এসে একাত্তরের সঙ্গে হবহু এক বিন্দুতে মিলে যাচ্ছে। নতুন খান আতা ও গুরুসদয় দত্তের প্রয়োজন পড়ছে তাই। সমন্বয়কদের লক্ষ্য করে আবার তোরা মানুষ হ ডাকটি যাঁরা দেবেন। তেপ্পান্ন বছরে একটি স্থিতাবস্থার মধ্যে আমরা বেঁচে আছি;- আমাদের এখানে রিয়েলিটিকে ফিকশনে গ্লোরিফাই করা হয়েছে সবসময়;- ক্রিটিককে নয়।
. . .