এমন এক পৃথিবীতে আমরা বাস করি যেখানে আশাবাদী হওয়ার রসদ বড়ো অল্প। নাই বলা চলে। যেখানে যাই, যেদিকে নজর ফিরাই, হানাহানি-রক্তারক্তির উৎসব। মানুষ হওয়ার চেষ্টা কারো মধ্যে জীবিত নাই। স্বার্থপরতা নয়,- পরার্থপরতা। নিজের তরে নয়, অন্যের তরে নিজেকে বিলীন করার নসিহত একসময় আমাদের সমাজে বেশ ব্যাপক ছিল। ওয়াজি হুজুরদের মতলবি নসিহতের চেয়ে স্কুলপাঠ্য পুস্তকে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর জীবন ও বৃক্ষ টাইপ রচনা ছিল যার বড়ো প্যারামিটার।
তো এই সুবাদে বালপাকনা বয়সে ইমানুয়েল কান্টের মতো মহাদুর্বোধ্য ভাবুকদের সঙ্গে নামপরিচয় অন্তত ঘটছিল। উনাদের মতো দিকপাল চিন্তকদের ব্যাপারে জানার ক্ষুধা সেখান থেকে তৈরি হইছিল পরে। আবুল ফজলের ভাষান্তরে উইল ডুরান্টের দর্শনের ইতিহাস খিদে পূরণের প্রথম ধাপ ছিল। পরে বার্ট্রান্ড রাসেলের পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসসহ নানা বইপত্রের মধ্য দিয়া খিদেটা আগ্রাসী হইছিল আরো। জার্মান দর্শন ঘরানায় যেসব দিকপাল একে-একে আসছিলেন, উনাদের মধ্যে কান্টের নামখানা ইয়াদ করতেছি এজন্য,- মানবজীবনে নৈতিকতার স্থান ও ভূমিকা নিয়া বড়ো আকারের ফিলোসফি উনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
কান্টের মতে কারো আচরণ এমন হওয়া উচিত যেন অন্যরা এইটাকে মান ধরে অগ্রসর হওয়ার কথা ভাবতে পারে। মানদণ্ড এখন কী হবে সেখানে? উত্তরে যুক্তি ও নৈতিকতার পারস্পরিক বন্ধনের আলাপ তুলছিলেন এই জার্মান দার্শনিক। উনার মতে মানুষ যুক্তির দিক দিয়া পরিপক্ক হইতে পারে নাই বইলা তার আলোকায়ন এখনো অসম্পূর্ণ। যুক্তি যদি পরিপক্ক না হয় সেক্ষেত্রে নৈতিকতা অপরিপক্ক থাকতে বাধ্য। তারা পারস্পরিক এবং তাদেরকে স্থানকাল নিরপেক্ষ বা সকল যুগের মানুষের জন্য প্রযোজ্য হইতে হবে।
যুক্তি ও নৈতিকতাকে সর্বজনীন করতে কান্ট কাজেই মোটিভ বা উদ্দেশ্যর আলাপ তুলছিলেন। মানুষের আচরণ যুক্তিশীল ও নৈতিক কিনা সেইটা তার উদ্দেশ্যর উপ্রে অনেকখানি নির্ভর করবে। নিজেকে সে যখন যুক্তিশীল বইলা উপস্থাপন করে অথবা নৈতিক প্রাণী গণ্য করে, সেখানে তার মোটিভ বা মতলব আগে বুঝে আনা প্রয়োজন। মতলব যদি অন্যের ক্ষতিসাধন করা হয় তাইলে যুক্তশীল হইলেও তার কর্মকাণ্ডের সবটাই অনৈতিক। যদি সেরকম না হয় তাইলে বুঝে নিতে তার মধ্যে যুক্তি ও নৈতিকমান সহজাত ক্রিয়াশীল।
মোটিভ বা উদ্দেশ্যকে গুরুতর বইলা গণ্য করছেন কনিজবার্গের অকৃতদার দার্শনিক। উনি বিয়া করেন নাই, কারণ উনার মনে হইছিল, বিয়া করলে তাঁর ঘাড়ে যে-দায়িত্ব চাপবে সেইটা উনি বহন করতে পারবেন না। ভাবুকতায় ব্যাঘাত ঘটবে বিলক্ষণ। মানে দাঁড়াইতেছে, উনি উনার নৈতিকতায় স্বয়ং অটল ছিলেন সাংঘাতিক।
এখন নৈতিকতার অন্যতম বড়ো প্রসাদগুণ হইতেছে সত্যবাদিতা। কান্টের নীতি আমলে নিলে সত্যবাদিতা আসলে কেমন? যেমন এই প্যারাডক্সটা আমরা ভাবি, একটা নির্দোষ লোককে কেউ খুন করার জন্য তাড়া করছে। বেচারা জান বাঁচাইতে গলিরাস্তার মধ্য দিয়া কান্টের বাড়ির ভিত্রে ঢুকে পড়ল। জীবনরক্ষার মিনতি জানাইল তাঁকে। যারা খুন করতে চায় তারা এখন কান্টের বাড়িতে হানা দিয়া যদি লোকটার খবর জানতে চায়, তখন উনার অবস্থান কী দাঁড়াইতেছে সেখানে? কান্ট তো আগেই বইলা দিছেন,- কোনোপ্রকার ফল বা প্রাপ্তির আশায় নৈতিক হওয়া যাবে না। গীতার প্রতিধ্বনি করে বলতেছেন,- ফলের ভাবনায় না গিয়া নৈতিকতার অনুশীলন করতে হবে। একমাত্র এই অনুশীলনে নৈতিকতা সত্যিকার অর্থে স্বয়ংক্রিয় ও সর্বজনীন হইতে পারে। উনার থিয়োরি মানলে নিজেকে নৈতিক প্রতিপন্ন করার সুখ ও পরিতৃপ্তির জন্য মানুষ এইটা করবে না। সহজাত গুণ রূপে নৈতিকতা তার মধ্যে সক্রিয় হইতে হবে। সত্যবাদিতা সেরকম একখানা সহজাত গুণ। অন্যের ক্ষতি করা হইতে মানুষকে সে রক্ষা করবে।
নির্দোষ বা ইনোসেন্ট লোকটারে যারা খুন করতে চায়, তাদেরকে কান্ট কীভাবে মোকাবিলা করতেছেন এখানে? সত্য যদি স্বয়ং সহজাত গুণ হয় তবে উনি তাদেরকে বইলা দিতে বাধ্য,- লোকটা আমার ঘরে এসে লুকাইছে। সেক্ষেত্রে নির্দোষের প্রাণ যাবে এবং কান্টকে এর জন্য দায়ী ভাবা ছাড়া উপায় থাকতেছে না। সমস্যার বিহিত করতে কনিজবার্গের নিঃসঙ্গ ভাবুক যুক্তিবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছিলেন। যে-লোক নৈতিক হইতে চায় তার মধ্যে বিবেচনাজ্ঞান থাকতে হবে। এখানে যেমন মিথ্যা বলাটাই সত্য এবং মিথ্যাটা নৈতিক। সত্য বলাটা বরং নৈতিকতার লঙ্ঘন হইত। মানুষের পক্ষে এমতো নিষ্কাম নৈতিকতায় স্থির থাকা কি সম্ভব? যেমন সহজাত নিষ্কাম থাকে বৃক্ষ অথবা মাটি?
অধমের বিবেচনায়, মানুষের পক্ষে বৃক্ষের স্বভাব ধারণ করা সম্ভব না। বৃক্ষ কান্টের ওই জগৎ কেন আছে (?) – এই জিজ্ঞাসার সমতুল। কান্ট বলছিলেন বটে, জগৎ তার সমুদয় নিয়া নিজ হইতে আছে। কান্ট যার নাম দিতেছেন নোমেনা বা Things-in-themselves. এখন তারা কেন আছে, কার আজ্ঞায় আছে, কী কারণে আছে… ইত্যাদির কিনারা সম্ভব নয়। মানুষের ইন্দ্রিয় অনুভূতিতে সমুদয় জগৎ আপনা হইতে ক্রিয়াশীল হইতেছে। আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়া আমরা হয়তো তারে অনুভূত হই কিন্তু তার অস্তিত্বের কার্যকারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন।
বস্তুসমুদয়ের সঙ্গে যখন কোনো ঘটনা বা ইভেন্টে আমরা জড়িত হই তখন সেইটা যুক্তি এবং এভাবে অগ্রসর হইলে নৈতিকতার জায়গায় উপনীত হইতেও পারে। ঘটনা বাদ দিলে বস্তুসমুদয় ঘটনা-নিরপেক্ষ অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। সোজা কথায় জগতের উপস্থিতি ও সক্রিয়তা পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ অবস্থায় বিদ্যমান থাকতেছে। কান্টের এই ভাবনার প্রতিচ্ছিবি পদার্থবিজ্ঞানী জন আর্চিবল্ড হুইলারের মধ্যেও পাইতেছি। হুইলার বলছিলেন বটে,- মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ (Observer Neutral) অবস্থায়ও সক্রিয় থাকে। যখন পর্যবেক্ষণ করি তখন সে আমাদের কাছে সত্য ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হইতে থাকে, অন্যথায় তার অস্তিত্ব বোঝার উপায় নাই। সে নিজেই নিজেরে নিরিখ করতে থাকে। হুইলার আই নামক ডায়াগ্রামের সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছিলেন ধীমান বিজ্ঞানী। বিজ্ঞান ল অব নেচার বলতে এখন যেইটা বোঝে তার নেপথ্যে কাজেই ইমানুয়েল কান্টের প্রভাব বেশ গভীর।
মানুষ ব্যতীত যত কিছু জগতে আছে তাদের স্বয়ংক্রিয়তার সঙ্গে মানুষের তফাত আছে। মানুষের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়তাটা অন্যদের মতো আপনা-আপনি কাজ করে না। সে এগুলারে ম্যানিপুলেট করে। যুক্তি দিয়া বৈধ বা অবৈধ প্রতিপন্ন করে। এর ফলে তার কর্ম বা অ্যাকশন কান্টের সর্বজনীন নীতির জায়গায় সহজাত থাকে না। প্রাকৃতিক সত্তা ও স্বজ্ঞা মানুষের মাঝে ক্রিয়াশীল থাকার পরেও সে অপ্রাকৃত ও নিজস্ব হইতে চায়। মাটি তেমন নয়। বৃক্ষরা নয়। জগতের কোনোকিছু নয়। জগতের সমুদয় বস্তুর সঙ্গে মানুষের তফাতটা এখানে ভীষণ মৌলিক।
মাটির মধ্যে সহজাত পরার্থপরতার আলাপ মারিয়াম মাহজাবিন তাঁর ভিডিও পডকাস্টে তুলছিলেন। এক-দেড় বছর আগে শুনছিলাম সেইটা। উনাকে আমি চিনি না। গানটান করেন সেইটা জানছিলাম নেট ঘেঁটে। পেশাদার না,- শখে করেন মনে হয়। মিট্টি স্টুডিও নামে একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে উনার। দু-একখান ভিডিও ছিল সেখানে। পারিবারিক বন্ধনের মামলায় পশ্চিম গোলার্ধের সায়েব-মেমদের সঙ্গে আমাদের তফাত বোঝাইতে একখানা গান শুনছিলাম তখন। ভালো লাগছিল শুনে। মাটি ও মাটির দেহে তৈরি মানুষকে নিয়া ভিডিওটা অবশ্য তার মধ্যে সেরা। মাটির চরিত্র ও গুণ চমৎকার তুলে অনছিলেন মাহজাবিন। পিওর থটস বলা যাইতে পারে। শোনার পর মনে হবে, দারুন তো! এভাবে কখনো ভেবে দেখে নাই! তো উনি মাটির যেসব গুণ মানুষের মধ্যে থাকা উচিত বইলা মনে করেন, এখন সেইটা বনিআদমে সক্রিয় করানো কঠিন। যতক্ষণ না সে কান্টীয় তরিকায় যুক্তি দিয়া উপলব্ধি করতে পারতেছে,- তারে মাটির মতো হইতে হবে।
মারিয়াম মাহজাবিনের কথাখান তথাপি মূল্যবান,- মানুষ মাটির তৈরি হোক অথবা অন্যকিছুর, মাটির সর্বংসহা গুণ উপলব্ধি করা তার জন্য ফরজ। মাটি হইতেছে ধরিত্রী। জীব ও জীবনকে লালন করে। তাদের অবক্ষয় ঘটলে ধারণ করে। তার এই দ্বৈতগুণে সক্রিয় অদ্বৈতকে মানুষ যখন টের পায় তখন সে বোঝে মাটি হইতেছে এমন এক আমিসত্তা যার ভিত্রে বকিরা ক্রিয়াশীল। আমি আদতে সমুদয় নোমেনা বা things-in-themselves-এর সামষ্টিক আকার।
হাসন রাজা এইটা টের পেয়ে বইলা গেছেন,- আমি হইতে আল্লা রছুল, আমি হইতে কুল্/ পাগলা হাছন রাজা বলে, তাতে নাই ভুল।/ আমা হইতে আসমান জমিন আমি হইতেই সব।/ আমি হইতে ত্রিজগৎ, আমি হইতে সব। নিজের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডকে লীলাময় দেখে যে-মানুষ সে হইতেছে সত্যিকার নৈতিকপ্রাণী। এই লোকের পক্ষে কারো অনিষ্ট করা সম্ভব না। না সম্ভব মিথ্যার চাষাবাদ। না তার পক্ষে সাজে নির্মমতা। সে হইতেছে মাটি। মাটির গুণধারী সাক্ষাৎ মাটির মানুষ।
. . .