. . .
এ-বছর বুকার প্রাইজ জিতলেন ইংরেজ লেখক সামান্থা হার্ভে। প্রতিযোগীদের লম্বা তালিকা থেকে শেষপর্যন্ত সামান্থার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি অরবিটালকে বুকার কমিটি বেছে নিয়েছেন। বছর খানেক আগে প্রকাশিত বইটি লিখতে সামান্থা সময় নিয়েছেন প্রায় পাঁচ বছর। গুডরিডস-এ বইটি নিয়ে অনেকের উচ্ছাস তখন চোখে পড়েছিল। বুকারলিস্টে নাম উঠার সঙ্গে-সঙ্গে যেসব ইউটিউবার বইয়ের রিভিউ করে থাকেন, তাদের অনেকে সামান্থার এই কল্পআখ্যান পাঠের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন তাৎক্ষণিক। মোটা দাগে ইতিবাচক হলেও দ্য ডিস্কো কিংয়ের প্রতিক্রিয়ার পুরোটাই নেতিবাচক সেখানে। সামান্থার বইটিকে উনি বুকারলিস্টের যোগ্য নয় বলে খারিজ করতে পিছপা হয়নি। ডিস্কো কিংয়ের বইপাঠ ও প্রতিক্রিয়ার ধারাটি অবশ্য এরকমই। উন্নাসিকতা তার ক্ষেত্রে সহজাত। দর্শকরা বিষয়টি জানেন বিধায় মন্তব্য বিভাগে বইটির ব্যাপারে মিশ্র অনুভূতি দেখতে পাচ্ছি। ডিস্কো কিংয়ের সঙ্গে অনেকেই সহমত পোষণ করেছেন। অন্যদিকে কিছু দর্শক আবার মন খুলে প্রশংসা করতে কৃপণতা করেননি। ডিস্কো কিং বাদে বইটির ব্যাপারে বাকিদের পাঠ-প্রতিক্রিয়া মোটামুটি ইতিবাচক। মুগ্ধতা ঝরেছে বেশ।
সামান্থা হার্ভের কল্পআখ্যানের বিষয়বস্তু এমন, বাজারে আসার পর পাঠের তাৎক্ষণিক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, যদিও পরে আর পড়া হয়ে ওঠেনি। বড়ো কারণ, উনার এই নাতিদীর্ঘ রচনা মাগনা পাঠের সুযোগ নেই। অন্তর্জালে মওকাটি সহসা জুটবে বলে মনে হচ্ছে না। সম্বল বলতে দ্য গার্ডিয়ান–এ প্রকাশিত প্রতিবেদন, পুরস্কৃত হওয়ার আগে-পরে রাখা পড়ুয়াদের পাঠ-প্রতিক্রিয়া, আর গুডরিডস-এ সংকলিত বইয়ের টুটাফাটা অংশ। এসবের ওপর ভর করে পাঠ-মূল্যায়ন সম্ভব নয়। মূল বইটি অন্তর্জালে সুলভ না হওয়া অবধি পরের মুখে ঝাল খেয়ে বিশেষ ফায়দাও নেই। তথাপি একাধিক কারণে বুকারের এই নির্বাচনকে ব্যতিক্রম মানতে হচ্ছে। কেন সেকথাগুলো আপাতত টুকে রাখা জরুরি মনে মানছি। পাঠের সুযোগ হলে পরে নাহয় মিলিয়ে নেওয়া যাবে। প্রয়োজনে শুধরে নিতেও সমস্যা থাকবে না।
পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চব্বিশ ঘণ্টায় ষোলবার পাক খেতে থাকা নভোযানে ছয় নভোচারীকে উপজীব্য করে সামান্থা বইটি লিখেছেন। মহাবিশ্বের আদিঅন্তহীন বিস্তারে নভোযান পাক খাচ্ছে। ছয়জন নভোচারী সেখান থেকে ছেড়ে আসা মানবগ্রহকে নিরিখ করে চলেছেন। মহাশূন্যে ভাসমান অবস্থায় আশ্চর্য প্রাণের উদ্ভাসে মুখর গ্রহটি তাদের সত্তার প্রতি পরতে নিজেকে মেলে ধরছে। পৃথিবীতে রেখে আসা পরিজনদের সঙ্গে নভোচারীরা ইমেইল চালাচালি করেন। মাঝেমধ্যে অডিও বা ভিডিওকলে আলাপ হয়। এর পাশাপাশি চলতে থাকে অনন্ত পরিসরে গতিশীল মহাশূন্যে পাক খাওয়া ও সেখানকার পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে চলার ইতিবৃত্ত। পৃথিবী ও মহাশূন্য… আপেক্ষিক দুই পরিসরে নভোচারীদের যাপন করার অভিজ্ঞতা সামান্থা হার্ভে মূলত বইয়ে ধারণ করতে চেয়েছেন। তাদের চোখ দিয়ে অনুভব করতে চেয়েছেন সেই অভিজ্ঞতা যেটি স্থানকালের নিরিখে আপেক্ষিক। স্থানকালের পরিসর যখন বদলে যায় তখন আসলে কী ঘটে? সামান্থা মনে হচ্ছে উত্তরটি খুঁজে ফিরেছেন নিজের উপন্যাসিকা প্রায় আখ্যানের পাতায়।
. . .
পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় ছয় নভোচারী সেখানকার স্থানকালকে যাপন করেছেন। এখন তারা স্থানকালের এমন এক পরিসরে আছেন যেটি পৃথিবীর মতো নয়। সেখান থেকে আমাদের গ্রহপানে তাকানোর অনুভূতি কাজেই ভিন্ন হতে বাধ্য। নভোচারীরা বিষয়টি যত অনুভব করতে থাকেন, তাদের ভাবনার জগৎ ক্রমশ বদলাতে থাকে। মনোজাগতিক সে-বাঁকবদলের কাহিনি সামান্থার সম্বল। পাঠকের ভালোমন্দ প্রতিক্রিয়া আর গুডসরিডস-এ সংকলিত বাছাই অংশ পাঠ করে আগ্রহ-উদ্দীপক কিছু বিষয় কাজেই চোখে ধরা পড়েছে। সেগুলো এখন বলি বরং :
নাম্বার ওয়ান, নামে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি হলেও অরবিটাল-এর বয়নশৈলীতে কাহিনির ঘনঘটা অনুপস্থিত। কল্পকাহিনি বা যে-কোনো আখ্যানে স্টোরি টেলিং হচ্ছে কেন্দ্রীয় বিষয়। পাঠক কাহিনি শুনতে চায়। কাহিনির লেজ ধরে সূচনা, মধ্য ও অন্তে পৌঁছার আশা করে। এর লেজ ধরে অগ্রসর হতে যেয়ে বিচিত্র পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তাকে। নাটকীয়তা ও ক্লাইমেক্স পাঠককে অনেকসময় জব্দ রাখে। বিবিধ অনুষঙ্গকে যেখানে লেখকরা কল্পনাশক্তি দিয়ে অবিরত জুড়তে থাকেন। অরবিটাল এখানে পাঠককে নিরাশ করবে বলে মনে হচ্ছে। স্টোরি টেলিংয়ের স্বীকৃত ফর্মুলা সামান্থা হার্ভে গোনায় ধরেননি। নিটোল কাহিনি আশা করে যেসব পাঠক বইটি হাতে নেবেন,- আশাভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে সেখানে।
নাম্বর টু, আখ্যান জাতীয় টেক্সটে চরিত্র নির্মাণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ঘটনাপ্রবাহের ভিতর দিয়ে পাঠকের কাছে চরিত্রকে অমোঘ করেন আখ্যানকার। উপন্যাস পড়তে বসে একজন পাঠক কেবল কাহিনি পাঠ করেন না,- কাহিনির ভিতর দিয়ে বিকশিত চরিত্রগুলোকে তিনি পাঠ করে থাকেন। তাদের ব্যক্তিত্ব বা পার্সোনাকে অনুভব ও বিশ্লেষণ করেন। ভালোমন্দ প্রতিক্রিয়া জানাতে ত্রুটি করেন না। উপন্যাসের কাহিনি কার্যত চরিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে বৈধতা বা ভ্যালিডিটি লাভ করে। প্রথাটি সনাতন হলেও আজো এর গুরুত্ব অমলিন।
অরবিটাল-এর বয়ানে সামান্থা হার্ভে মনে হচ্ছে একে উপেক্ষা করেছেন। ছয় নভোচারীকে পাঠকমনে গেঁথে দিতে ক্যারেক্টার ডেভোলাপমেন্টের অবধারিত অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে বইটি লিখেছেন তিনি। মানে দাঁড়াচ্ছে,- পাঠক ছয়জন মানুষকে সেখানে পাচ্ছে, তাদের বৈশিষ্ট্যও হয়তো তিনি তুলে ধরেছেন, কিন্তু এসবের ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি চরিত্রকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা এবং সবল-দুর্বল ইত্যাদি দাগানোর অবকাশ বড়ো একটা রাখেননি এই ইংরেজ লেখক। চরিত্র নির্মাণ বা ক্যারেক্টার ডেভোলাপমেন্টকে ছেটে ফেলে আখ্যান রচনা দুরূহ কাজ। স্বাভাবিক নয় মোটেও। অরবিটাল-এর বয়ানে অস্বাভাবিক ঘটনাটি বোঝা যায় সামান্থা ঘটিয়েছেন।
নাম্বার থ্রি, মহাকাশচারীদের মধ্যে আলাপ অর্থাৎ সংলাপ তৈরির দিকে বিশেষ মনোনিবেশ করেননি সামান্থা হার্ভে। মাঝেমধ্যে তারা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে, এবং দীর্ঘ হওয়ার আগে লেখক সেটি ছেটে দিচ্ছেন। ডায়ালগ মেকিংয়ের সাহায্যে চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার মান্য প্রথাটি বাদ দিয়েছেন একপ্রকার।
নাম্বার ফোর, প্রশ্ন হলো,- তাহলে কী চলছে সেখানে? আখ্যানটি কোন খুঁটির ওপর ভর করে দাঁড়াচ্ছে তবে? গুডরিডস-এ সংকলিত অংশ পাঠ করে মনে হলো,- মহাকাশে পাক খেতে থাকা নভোযানে বসে ছয় নভোচারীর অভিজ্ঞতা তাদের মনোজগতে যেসব অনুভূতি ও ভাবনার বুদবুদ তুলছে, সামান্থা এখন সেগুলোকে বয়ান আকারে লিখেছেন। মানবগ্রহকে কেন্দ্র করে পাক খাওয়ার সুবাদে পৃথিবীকে একাধারে মনোরম ও ভঙ্গুর বোধ হওয়ার অনুভূতি নভোচারীদের মনোজগৎ থেকে টেনে বার করেছেন লেখক। অরবিটালকে সুতরাং ছয়জন নভোচারীকে উপলক্ষ বানিয়ে স্বয়ং লেখক সামান্থা হার্ভের মনোতারে বইতে থাকা ও সেখান থেকে বিচ্ছুরিত ভাবনার বিস্ফার বললে আশা করি অতিরঞ্জন হবে না।
নাম্বার ফাইভ, ভাবনা ও অনুভূতিকে বিবরণ-আকারে হাজির করায় আখ্যানটিকে চিন্তা উদ্রেককারী বা থট প্রভোকিং কিছু বলে পাঠক ধরে নিতেও পারে। দ্য ডিস্কো কিংয়ের রিভিউ শুনে মনে হলো এখানে এসে উনি বিরক্ত। কারণ, নভোচারীদের মহাশূন্যে পাঠিয়ে যে-বিবরণ লেখক পাতার-পর-পাতায় দিয়ে যাচ্ছেন, এখন সেটি গভীর অর্থ পয়দা করেছে বলে তাঁর মনে হয়নি। ভাবনার জগৎকে তছনছ করে দিতে পারে অথবা চিন্তার পরিসরকে উসকানি দিয়ে যায়,- এরকম কোনো দার্শনিকতা বা ফিলোসফি সামান্থা হার্ভে অরবিটাল-এ দাঁড় করাতে পারেননি। আখ্যানটিকে কাজেই ব্যতিক্রম ও গুরুত্বপূর্ণ বলে হাইপ তৈরি করা ডিস্কো কিংয়ের পোষায়নি।
গুডরিডস-এ সংকলিত অংশগুলো পাঠ করে আমার সেরকম লেগেছে কিছুটা। যেমন লেখক বলছেন, পৃথিবী রঙিন। তো এই দারুণ মনোরম স্থানে থেকেও আমরা ভাবি,- স্বর্গ বোধহয় অন্য কোথাও আছে। কিন্তু মহাকাশচারীর জীবন বেছে নিলে সেরকম মনে হয় না। সে তখন ভাবে,- আমরা সবাই এরিমধ্যে মারা গেছি এবং এখন এই অনন্ত অসীমে পুনর্জীবন লাভ করেছি। পুনরুত্থান ঘটে গেছে আমাদের। নতুন কথা কি? না, নতুন নয় একদম। তবে ওই-যে মহাকাশের প্রেক্ষাপট থেকে বলছেন,- সেজন্য পড়তে মন্দ লাগছে না।
তো এই জায়গা থেকে মনে হলো, সামান্থা হার্ভের মূল শক্তি হচ্ছে অলঙ্কার বর্জন করে এমন এক ভাষাচিত্র তিনি গড়েছেন, যার জোরে আখ্যানটি প্রচলিত অর্থে আখ্যান না হয়েও বেশ উতরে গেছে। লেখার নতুন ধরন বটে, এবং আমাদের ভাবা উচিত। আগামীর পৃথিবীতে চিন্তাপ্রধান বিবরণ ভাষাচিত্রে রূপ নেবে। চরিত্র যেখানে স্বয়ং ওই ভাষাচিত্রের বাহক। রানার বা ডাকপিয়ন। এর অধিক তাকে ফিল না করলেও বোধহয় ক্ষতি নেই।
. . .
. . .