মিথ্যার ইতিহাস জানতে ইচ্ছে করে। এখানে ওখানে টুকটাক পড়েছি মনে পড়ে। উপলব্ধি কি করেছি? অথবা এটা অনুভব করা কি খুব জরুরী যে মিথ্যা কী? এই যে- যাহা বলিবো সত্য বলিবো সত্য বই মিথ্যা…. কোরানে, পুরাণে হাত রেখে উদভ্রান্ত উচ্চারণ- তারই-বা শুরু কীভাবে? এখন দেখি অনেকে প্রায় উন্মাদ হয়ে যান মিথ্য কিছু পড়লে। বিশেষ করে রাজনীতির কোনো লোক যখন সত্য বলেন বলে মনে হয়- ওহ! তখন অথৈ সাগরে যেন নতুন দ্বীপ দেখতে পাই- কেননা এখন পর্যন্ত তাদের মতো মিথ্যা বলার কৌশল খুব কম মানুষই আবিষ্কার করতে পেরেছেন।
কেন একদল লোক অবিরাম মিথ্যায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে? শুধুই কি পাগলামি? জাগতিক জজবা দেখানোর নেশা? না কি ডি এন এতে- লেখা কোনো গল্পের নাম হলো মিথ্যা? প্রথম মিথ্যুক কে বা কোন সে জাতি? আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার পিছনে তাদের ভুমিকার গুরুত্ব কতটুকু? তারা কি তখন মিথ্যা বলতে বাধ্য ছিলো? না কি এটা একটা খেলা ছিলো চোর পুলিশের মতো?
আমি তো আজ পর্যন্ত খুব কম কথা বলেছি, যার সাথে সামান্য হলেও কাল্পনিক কোনো কিচু জুড়ে দেইনি। এরই-বা কারণ কী? শৈশবে খুব কষ্ট হতো এসব নিয়ে। হুজুর কতোভাবে বুঝাতেন,- মিথ্যা বলতে নেই। তখন গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারতাম না বলে আমার মনোবিজ্ঞানী হুজুরেরা অতি সহজে ধরে ফেলতেন, আর তখন কী এক পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠতেন কেউ কেউ! কিশোর তালেবেইলমের ঘার থেকে মিথ্যা নামক শয়তান নামানোর বিশাল নির্মম আয়োজন দেখার দৃশ্য আজো চোখে ভাসে।
যতদূর জানি, প্রকৃতিতে মিথ্যা ছিল না। ছিল নানান গঠন ও ঘটনা। শব্দ ও স্তব্ধতা, পূর্ণ ও অপূর্ণের অনুভূতি। এখানে অদ্ভুত এক মিথ্যুক এসে চারপাশে মাকড়সার জাল বানিয়ে ফেল্লো অনায়াসে- যেন অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতায় মোড়ানো এক বল- যা একেক-সময় একেক-জনকে লাথি দিতে উৎসাহিত করছে।
এই-যে আজ রাষ্ট্র নিয়ে বিচিত্র এক মনোমুগ্ধকর খেলায় নিমজ্জিত আমরা- তারও তো কারণ খুব দূরের কিছু নয়। তার মানে কি কিছু মানুষ তার নিজের ভুবনে বিভোর থাকবে বলে মিথ্যার আশ্চর্য আশ্রয়ে যেতে নিজেকে বাধ্য মনে করে? এছাড়া তার কোনো গতি নেই? নিখাদ মিথ্যা বলতে কি কিছু আছে? মিথ্যা বলার পর বমি বমি, মানসিক যন্ত্রণা, অসম্ভব অস্বস্তি কেন হয়? মিথ্যার অস্ত্রে অনেক মানুষ চোখের পলকে নাই হয়ে গেলে কেন আফসোস হয় অথবা তখনও কেউ কেউ নির্বিকার থাকি? মিথ্যা উদ্ভাবনের পরই তো বলা হলো আমাদেরকে সত্য বলতে হবে। সত্য বই…. যা বলা যাবে না তা আবিষ্কারই বা কেন? তবে কি আমরাই সেই ঈশ্বর- যে সত্যি মিথ্যাকে নিয়ে খেলতে ভালোবাসে? অনেকে বলে স্বর্গ হলো সত্যের আর মিথ্যা হলো নরকের প্রতীক। একবার স্বর্গে, আরেক বার নরকে যাওয়া আসার মানসিক আনন্দের অথবা যন্ত্রণার এই খেলার উদ্ভাবক কে বা কারা?
কেউ একটু আলো ফেলবেন এই ধোয়াশাময় জগতে?
. . .
১। জুলাই আগস্ট টার্মওয়েলে একটা লাইন মাথার মধ্যে ঘুরছিল :
সত্য এক অমোঘ কবিতা
যে যার মত পাঠ করে নেয়।
২। আমার মনে হয় পৃথিবীতে এখনও কিছু আদি গোষ্ঠী পাওয়া যেতে পারে যাদের শব্দভাণ্ডারে সত্য, মিথ্যা কিংবা ধর্ষণ শব্দটা নাই।
৩। মিথ্যা কিন্তু আরেক দিক থেকে চিন্তা করলে কল্পনা বা সৃষ্টিশীল কিছু।
৪। বেলাল ভাইয়ের পোস্ট পড়ে সালমানের সাথে আলাপ করছিলাম মিথ্যার ইতিহাস নিয়ে, ও যেটা বলল মিথ্যার অর্থ যদি হয় ব্লাফ দেয়া, তাহলে বহু প্রাণীর মধ্যে এটা আছে। টিকে থাকার স্বার্থে এমনকি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও। খাদ্যশৃঙ্খলে প্রাণীরা ভক্ষক, শিকার কিংবা পোষককে ধোঁকা দিয়ে টিকে থাকে।
৫। বেলাল ভাইয়ের মনের অবস্থার সাথে আমিও নিজের কিছুটা মিল পাই, আমি হঠাৎ করে মিথ্যা বলতে পারি না, তবে আগে থেকে সুপরিকল্পিত থাকলে বলতে পারি।
৬। সেপিয়েন্স গ্রন্থে মিথ্যার উদ্ভবের ইতিহাস কিছুটা পাওয়া যেতে পারে, ভাষা উদ্ভবের প্রথম দিকে তা ছিল কিছু ইনফরমেশনের বাহক। কিন্তু পরবর্তীতে টিকে থাকার জন্য কিংবা যুদ্ধ করার জন্য যখন জাতীয়তাবাদ, ঐক্য বা টিম-ওয়ার্কের দরকার পড়লো কিংবা দলনেতা হওয়ার জন্য, মিথ্যে বলা কিংবা মিথ্যে অভিনয় এগুলোর প্রয়োজনীয়তা বাড়তে লাগলো। গল্প কিংবা মিথ্যে উৎসাহ এভাবেই যাত্রা শুরু করলো…
. . .
সত্য নগ্ন এবং কূপবাসী
. . .
সত্য, মিথ্যার পুরা ধারণাটা আপেক্ষিক রাাজিব ভাই। আপনার দুই নাম্বার পয়েন্টটা এখানে মার্ক করতে হইতেছে। এখানে যে-কথা বলছেন সেইটা যদি আমলে নেই তাহলে আদিম সভ্যতা ও পরবর্তী নগরসভ্যতায় যাত্রার মধ্যে সত্য, মিথ্যার ধারণাগুলা মানব প্রজাতির মনে সক্রিয় হইতে শুরু করে। আদিম শিকারি মানব প্রজাতিরে কাছে সত্য, মিথ্যার ধারণা হয়তো ভিন্নতর ছিল।
টাইম মেশিনে করে আমরা যদি ওইসময় যাইতে পারতাম, তাহলে দেখা যাইত, তাদের মধ্যে কেউ হয়তো কোনো কারণে মিথ্যা কী সেইটা না জেনে মিথ্যা বলতেছে। আমরা নৈতিকতার জায়গা হইতে এগুলাকে সংজ্ঞায়িত বা নির্দিষ্ট করছি, ফলে সত্য, মিথ্যা নিয়া আলাপের আদিঅন্ত সুরাহা কোনোদিন হবে না।
একদিকে এইটা নৈতিকতার মানদণ্ড, অন্যদিকে নৈতিকতা স্বয়ং পরিস্থিতি সাপেক্ষে সত্য, মিথ্যাকে চেঞ্জ করে দিতে পারে। যেইটা মিথ্যা সেইটা সত্যে, এবং সত্য পরিণত হইতে পারে মিথ্যায়। যেমন ধরেন, জুলাই আন্দোলনে যারা এখনো আস্থা রাখেন উনাদের কাছে হাসিনাপতনের ঘটনা মিথ্যচারের উপ্রে দাঁড়ানো কোনো ষড়যন্ত্র নয়। তারা একে সত্য ও বিপ্লব বইলা মানতেছেন। আরেকদল তার বিপরীত। জ্বলজ্যান্ত এই সময়ে আপনি কিন্তু দুইটা ন্যারেটিভে বিভক্ত হইতেছেন। তো এখন সত্য, মিথ্যা এখানে কী দিয়া বুঝবেন?
সমস্যাটি ধরতে পারছিলেন বইলা গ্রিক প্রকৃতিবিজ্ঞানী ও ভাবুক ডেমোক্রিটাস বলছিলেন :- Of truth we know nothing, for truth is in a well. মানে হইল, সত্যের ব্যাপারে আমরা আসলে কিছু জানি না, তবে এইটা জানি, সত্য কূপে আত্মগোপন করে আছে। উনার এই ইশারাঘন কথাটা এখানে সত্য, মিথ্যা নিয়া আমাদের হাজার বছরের দ্বন্দ্বকে এক্সপোজড করে দিতেছে। ডেমোক্রিটাসের এই বচন থেকে ফরাসি ছবি আঁকিয়ে জাঁ লিও জেরোমি দারুণ একখান ছবি আঁকছিলেন। সত্যের দেবী নগ্ন অবস্থায় কূপ হইতে বের হয়ে আসছেন, উনার হাতে ছড়ি। সত্য হয়তো অনুপম নগ্নতা। সে যখন বাহির হয়,- মিথ্যা তখন পিটুনি খাওয়ার ভয়ে পালায়।
. . .