ভাষা নিয়া জনাব সলিমুল্লাহ খানের নসিহত শুইনা যে-আলাপটা হইছিল গতকাল
যে-ভাষাকে আক্রমণ করে সে-ই ভাষাকে বাঁচায়
(কমলকুমার মজুমদার)
. . .
সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্যটি আগে শুনছি সায়েম। শুদ্ধ ভাষা জিনিসখানা কী? খায় না মাথায় দেয়? আমার তো ভাই বুঝে আসে না। আঞ্চলিক বা উপভাষা আমাগো সম্পদ। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির পেছনে যার অবদান বলে বোঝানোর না। ছোট্ট দেশ কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে দেশটারে এত বেশি বৈচিত্র্যময় দেখতেছি আমরা! সমস্যা একটাই সেখানে, এক অঞ্চলের ভাষা অন্য অঞ্চলের মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। তো এই জায়গা থেকে দেশের সবাই বুঝতে পারেন এমন একখান ভাষারীতি দরকার আছে। ওই ভাষারীতি দিয়া যেমন খবর পড়া যাবে, তেম্নি কোর্ট-কাছারি থেকে আরম্ভ করে সকল কাজ করা যাবে। এমন এক-একখান ভাষারীতি পৃথিবীর সকল ভাষায় সময়ের প্রয়োজনে গড়ে উঠছে। তারে আপনে মানভাষা বা শুদ্ধ ভাষা কইতেছেন এখন। প্রশ্ন হলো, মান বা শুদ্ধ ভাষাটা একজনকে সঠিক জানতে হবে কেনো? শুদ্ধ কইতে গিয়া যদি যদি আঞ্চলিক টোন তার কথায় আইসা যায়, এর জন্য কি আপনে তারে কাঠগড়ায় তুলবেন? মামলা তো কমিউনিকেশনের ভাই। আঞ্চলিক টোনে শুদ্ধ কইতে গিয়া লোকজনের যদি সেইটা ধরতে অসুবিধা না হয় তাইলে সমস্যার কারণ দেখি না। আগে কমিউনিকেশন, তারপর আর্ট। সলিমুল্লাহ বোধহয় কথাখান ইয়াদ করতে পারতেছেন না!
যে লোক সুন্দর করে সহি শুদ্ধ কইতেছে, তারে আমরা সাধুবাদ জানাই। এরকম কইতে পারাটা কানে ভালো লাগে শুনতে। এইটা স্টাইল হইতে পারে। আমরা বলি না, সুন্দর করে কথা কইতে পারাটা আর্ট। সে সুন্দর করে বলতেছে, ছিমছাম শব্দ চুজ করতেছে, ডেলিভারি চমৎকার। আপনি এইটারে এখন আর্ট কইয়া বাহবা দেন। অসুবিধা নাই তো। কেউ যদি এইটা কপি করতে চায় তো করুক। নো প্রব্লেম।
অন্যদিকে যে-লোকটা সুন্দর করে কইতে পারতেছে না, তারটা আর্ট মনে না হইতে পারে কিন্তু তার কথা যদি সবাই বুঝতে পারে, সেক্ষেত্রে পারপাস সার্ভ হইছে মানতে হবে। আর সেইটা আগে দরকারি। সোজা কথায়, Language is for communication, not for dominance. তার দেহে প্রবাহিত ও তাকে সমৃদ্ধ করতে থাকা দেশি-বিদেশি-আঞ্চলিক ওরফে উপভাষাগুলার উপ্রে আধিপত্য বিস্তার করা কিন্তু মান বা শুদ্ধ ভাষার কাজ না। এখান থেকে ভাষা সাম্রাজ্যবাদ জন্ম নিয়া থাকে। সলিমুল্লাহ কি ভুইলা গেলেন কথাখান?
. . .
উনি আসলে এসব কথা বুঝেশুনে বলতেছেন? কারণ তিনি শুদ্ধবাদী হইতে চান। নিজেকে অন্য গোত্রে রাখতেই উনার আনন্দ। উনি ইউনিক, বাকিরা পচা। উনার সঙ্গে কলকাইত্তা বামুন গরবে গরবিনী বুদ্ধিজীবীর কি ফারাক? বিদ্বান লোক তিনি। রাতদিন বইয়ের পাতায় ডু্ইবা থাকেন। সিম্পল বিষয়টা নিয়া ত্যানা পাকানো কি সাজে তাঁর? কারণ কিন্তু একটাই, মনের ভিত্রে নিজেকে বিশিষ্ট ভাবার অহংকার তিনি ছাড়তে পারতেছেন না। অজান্তে উনার ভিত্রে সেইটা কাজ করতেছে। ইচ্ছায় করতেছেন এমন না। অনিচ্ছায় বা অজান্তে সিন্ধবাদের ভূত ঘাড়ে চেপে বসছে। যে-কারণে এসব বলতেছেন।
পৃথিবীর সকল দেশে শুদ্ধ কইতে না পারার সমস্যা আছে। আমেরিকায়, আপনে ধরেন, ফিলাডেলফিয়ার লোকজন যে-উচ্চারণে ইংরেজি কইতে থাকে, সেখান থেকে যদি মিশিগান বা ক্যালিফোর্নিয়া যাইতে থাকেন অথবা কাছাকাছি নিউ ইয়র্ক… উচ্চারণে প্রভেদ পাওয়ার কথা। ইংরেজি ভাষার নিজেরই তো মা-বাপ নাই আর! ব্রিটিশরা এক উচ্চারণে মান বা শুদ্ধ কয়। স্কটিশরা অন্য উচ্চারণে ওইটা ডেলিভারি দেয়। আইরিশ আর অস্ট্রেলিয়ানরা তো কি কয় বুঝতে মাথা ঘোরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে হেরা আলগা টান জুইড়া বসে। আফ্রিকার কথা আর কী কমু! মান-শুদ্ধর ধার ধারে না বইলা আফ্রিকার সাহিত্য জগৎ কাঁপাইতে পারছে। ভারতে একসেন্ট একরকম, আরবি আর স্প্যানিশভাষী অঞ্চলে ইংরেজির মধ্যে জুইড়া বসছে সহি আরবি ও স্প্যানিশ টানে কথা কওয়ার কায়দা। দেশকাল অনুসারে যার সবটাই মান বা শুদ্ধ ধরা যাইতে পারে। না ধরলেও ক্ষতি নাই। উপভাষার সঙ্গে মান ভাষার বিরোধ নয় বরং বিনিময় রহিয়াছে, এবং সেইটা বেশি-বেশি হওয়া দরকারি।
সলিমুল্লাহ খানের চেয়ে এদিক দিয়া আমাগো লন্ডনি মাইয়া আগাইয়া আছেন। সুন্দর ও পরিষ্কার বলতে পারছে সে, ‘আমি শুদ্ধ ভাষা অত ভালা বুঝি না। আমি সিলেটি। সিলেটি মাততাম পারি।’ মা জননী তোমারে স্যালুট। ভাষা তোমার হাতে জন্ম-জন্মান্তর নিরাপদ, সলিমুল্লাহ খানদের হাতে না।
. . .