. . .
মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবে কাণ্ডারি হইছিলেন বিশ্ব জুড়ে করোনা মহামারির প্রকোপ শুরু হওয়ার বছর দুই আগে। সৌদি আরবের অর্থনীতিতে ধস তখন গোপন কোনো বিষয় ছিল না। তেলের বাজার ছিল পড়তির দিকে। করোনা মহামারি শুরু হলে হজের বাজারেও ধস নামে। এক রাতের নাটকীয় অভ্যুত্থানে ক্ষমতার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করা সালমান আদনান খাসোগি হত্যার দায় মাথায় নিয়া সৌদিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর মাস্টার প্ল্যান হাতে নেন। ভিশন ২০৩০ নামে বিশ্ব এখন যার সঙ্গে পরিচিত। ইসলামি মূল্যবোধ ও জীবনাচারে অভ্যস্ত সৌদিরা যেন নিজের ধর্মীয় ঐতিহ্য বিসর্জন না দিয়াও যুগের সঙ্গে কদম মিলিয়ে চলতে পারে সেজন্য সালমান একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত মাস্টার প্ল্যানে সংযুক্ত করেন। কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে কয়েকটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, যেমন…
১.. ওয়াহাবি মতবাদুপুষ্ট সালাফি ইসলামের রূপকার মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের প্রভাব কারো অজানা নয়। সৌদি রাজতন্ত্রের আদি ভিত স্থাপিত হইছিল মূলত ১৭২৭ সনে। সৌদি আরবে আজকের রাজ পরিবারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রভাবশালী ধর্ম সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের অবদান ছিল যুগান্তকারী। এর জের ধরে সৌদি রাজতন্ত্রের ভিত ১৭২৭ হইতে ১৭৪৪-এ এগিয়ে নিয়ে আসা হইছিল। যার পেছনে যুক্তি ছিল,- পৌত্তলিক আচারে পুনরায় অবরুদ্ধ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সৌদি আরবকে মুক্ত করা ও বিশুদ্ধ ইসলাম ফেরত আনার পেছনে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের লড়াই অবশেষে সফল হইছে। সুতরাং সৌদি রাজতন্ত্র এখন থেকে সালাফি ইসলামকে নীতিগতভাবে সৌদি আরবের জন্য ইসলামের প্রকৃত শিকড় বইলা স্বীকৃতি দিতেছে। এখন থেকে সৌদি রাজ পরিবারের ভিত ১৭২৭ নয় বরং ১৭৪৪-কে গণ্য করা হবে।
সৌদি আরবে রক্ষণশীল সালাফি মতাদর্শের অনুসারী শতকরা হিসেব কুড়ি শতাংশের অধিক নয় এখনো, কিন্তু সালাফিকে ইসলামের প্রকৃত শিকড় গণ্য করার প্রভাবে গোটা মুসলিম বিশ্বে ওয়াহাবি মতবাদের প্রসার ঘটে। যুবরাজ সালমানের জন্য সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল সৌদি জনমানসে অকাট্য রক্ষণশীল ইসলাম এবং রাষ্ট্রকে এর সকল প্রকার পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বের করে নিয়ে আসা। তো রিসেট বাটনে চাপ দিয়া সৌদি রাজতন্ত্রের ভিতকে পুনরায় ১৭২৭ সনে নিয়া গেছেন তিনি। বাংলাদেশে যারা সালাফি মদদপুষ্ট এবং অতীতের মতো মসজিদ, মাদ্রাসায় সৌদি পৃষ্ঠপোষকতা আশা করতেছেন, উনারা কপাল চাপড়াইতে পারেন। সালমান ওয়াহাবি মতবাদপুষ্ট দেশগুলোয় মসজিদ, মাদ্রাসা তৈরিতে সকল ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা ইতোমধ্যে বন্ধ করছেন।
ভালো উদ্দেশ্যে রিসেট বাটন চাপতে সমস্যা নাই। যুবরাজের এই মাইন্ডগেম অদ্য কাজে দিতেছে। সৌদি আরবের জাতীয় দিবস এখন থেকে ১৭২৭ বইলা সাব্যস্ত হইল;- এই মর্মে ডিক্রিও জারি করছেন যুবরাজ। সেইসঙ্গে উদার, সহিষ্ণু ও মধ্যপন্থী ইসলামচর্চাকে প্রাধান্য দিয়া মাস্টার প্ল্যানকে বাস্তবায়নে সক্রিয় তিনি। রক্ষণশীল সালাফিপন্থীরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ঠিক আছে, যুবরাজ তাদের গোনায় নিতেছেন না। মোল্লাদের কার্যত কোণঠাসা করে জোর কদমে নিজ মিশনে আগুয়ান তিনি। সম্ভবত কয়েক হাজার সালাফি নেতা এখন জেলে বন্দি দিন কাটাইতেছেন। শুরুতে উনার এসব সংস্কারের বিপক্ষে জনমত প্রবল হইলেও সাম্প্রতিক জরিপ বলতেছে দেশটির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ মধ্যপন্থী ইসলামের স্বপক্ষে রায় দিছেন, এবং যুবরাজের নেওয়া সংস্কারে আস্থা রাখতেছেন।
২.. সালমানের মূল অথনৈতিক কৌশল হইতেছে তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে সৌদি আরবকে বের করে আনা। সেই লক্ষ্যে তিনি পর্যটন ও বিনোদন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়া পরিকল্পনা সাজাইছেন। পাশাপাশি কৃষিপণ্য উৎপাদন ও শিল্পায়ন অগ্রধিকারের তালিকায় আছে।
ভালো উদ্দেশ্যে রিসেট বাটন চাপতে সমস্যা নাই। যুবরাজের এই মাইন্ডগেম অদ্য কাজে দিতেছে। সৌদি আরবের জাতীয় দিবস এখন থেকে ১৭২৭ বইলা সাব্যস্ত হইল;- এই মর্মে ডিক্রিও জারি করছেন যুবরাজ। সেইসঙ্গে উদার, সহিষ্ণু ও মধ্যপন্থী ইসলামচর্চাকে প্রাধান্য দিয়া মাস্টার প্ল্যানকে বাস্তবায়নে সক্রিয় তিনি।
৩.. ভিশন ২০৩০-এর আরেকটি বড়ো লক্ষ্য হইতেছে নারী-পুরুষের মেলামেশাকে সহজ করা। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সকল প্রকার মোরাল পুলিশিংয়ে ইতি টানার কাজেও যুবরাজ বেশ কামিয়াব এখন। কেবল রাস্তাঘাটে নয়, সর্বত্রই নারী এবং পুরুষ পাশাপাশি চলাফেরা করতেছেন। ড্রাইভিংসহ ব্যবসা ও চাকুরির বাজারে নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। আরব আমিরাতের মতো না হইলেও সৌদি নারীরা আর আগের মতো কঠিন রক্ষণশীল বাতায়নে বন্দি নাই। মুক্ত বিহঙ্গের মতো অংশ নিতেছেন সর্বত্র। তরুণদের মধ্যে যে-কারণে যুবরাজের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক।
৪.. শিক্ষার আধুনিকায়নের উপ্রে জোর দিতেছেন সৌদি প্রিন্স। ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে বিদ্যালয়ে পাঠ দান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পাঠের অংশ হিসেব সম্প্রতি মহাভারত ও রামায়ণকে পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হইছে। এর ধারাবাহিকতায় বিদ্যালযে গানচর্চা ও সংগীত শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেছেন যুবরাজ।
…
এমবিএস এই কথাটা অনেক জায়গা বলছেন বটে,- আমি মারা যাওয়ার আগে সৌদি আরবসহ আরববিশ্বকে আধুনিক ও সকল দিক দিয়া উন্নত দেখে মরতে চাই। এইটা আমার একমাত্র মিশন, কাজটি আমি করে ছাড়ব।
সময় বলে দিবে যুবরাজ সালমান তাঁর যজ্ঞে সফল হইতে পারবেন, নাকি তাঁকেও বাদশাহ ফয়সালের মতো অকালে প্রাণ দিতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমানসহ অন্য আরব রাষ্ট্রেকে সঙ্গী করে ঘোড়ার বেগে ছুটতেছেন যুবরাজ। আমরা ওদিকে সালাফি ইসলামের বর্বর অন্ধকূপে ফেরত যাইতেছি । বিচিত্র! বড়ো বিচিত্র লাগে সব!
. . .
. . .