. . .
এর মানে কি? বর্তমান বাস্তবতাকে সামনে রেখে এর কোনো ব্যখ্যা সম্ভব?
…
খুব ইন্টারেষ্টিং বিষয় বেলাল ভাই, কিন্তু সমস্যা হলো সোর্স কিংবা বিষয় নিয়ে লেখকের বিস্তারিত আলোচনা নাই কিংবা আপনার কোন সংযোজন নাই, থাকলে সমৃদ্ধ হতাম, নতুন একটা দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচয় ঘটত। বিষয়টা আইনগত কিংবা বিচারপদ্ধতি নিয়া, যেখানে বলা হচ্ছে “সব বিচারক যদি একমত হয় যে ব্যক্তি দোষী, তাইলে তারে মুক্তি দেয়া হবে, যুক্তি ছিলো অতিরিক্ত একমত মানে কোথাও সিস্টেমেটিক ভুল আছে বিচারে।”
এখানে দুইটা বিষয় খেয়াল করার মতো :
প্রথমত একটা ইয়াহুদি সমাজব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক সমাজ যার অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে ধর্মীয় নৈতিকতা। আমরা জানি যে, ইহুদি ধর্মের আইনের মূল উৎস ছিলো তোরাহ, তানাখ, মিশনা এবং তালমুদ ইত্যকার ধর্মীয় অনুশীলন। এই উৎসগুলো থেকেই ইহুদি সমাজের সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিকতার বিষয়টি একটা কাঠামো পায়, যেমন ইসলাম ধর্মে কোরান হাদিস হচ্ছে বিচারিক ও আইনগত কাঠামোর মূল উৎস।
দ্বিতীয়ত যৌক্তিক জ্ঞানকাঠামো অর্থাৎ যুক্তি দিয়ে বিচার করার পদ্ধতি। বর্ণিত ঘটনায় একধরনের যুক্তি খোঁজার প্রচেষ্টা রয়েছে। অর্থাৎ যুক্তি বলছে যে অতিরিক্ত একমত বিচারের সিস্টেমগত ত্রুটি।
যৌক্তিক কাঠামোতে উপরের বর্ণিত ঘটনাটা ব্যতিক্রমী হতে বাধ্য। কেননা সেই প্রাচীনকাল থেকে আজঅব্দি বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কিছু মানদণ্ডকে মৌলিক ধরে অগ্রসর হতে দেখা যায়। ব্যাবিলনের হাম্মুরাবির আইন, মিশরীয় ফারাওগণ কর্তৃক আইন, গ্রিসীয় নৈতিকতা কিংবা পরবর্তী সময়ে খুবই প্রভাবশালী রোমান আইন যা পশ্চিমা আইনের ভিত্তি বলা যেতে পারে তার সবটাই কোনো না কোনো যৌক্তিক মাপকাঠি দিয়ে পরিচালিত হতো। এই যৌক্তিক মাপকাঠির মধ্যে সমালোচনার অবকাশ আধুনিক মন ও বিচার পদ্ধতি দিয়ে করা সম্ভব হলেও সময়ের এবং রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে তার একটা উপযোগিতা ছিলো। বিচারকরা সেই সময়কার আইন মেনেই বিচারকাজ পরিচালনা করতেন। সেখানে রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা শাসকের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটা বিচিত্র নয়, বরং স্বাভাবিকই ছিলো। অনেক অন্যায় বিচারের উদাহরণ লিখিত ইতিহাসেও পাওয়া যায়।
কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়, প্রশ্ন প্রাচীন ইহুদি সমাজের উদাহরণ এবং যুক্তির দোহাই দিয়ে যে বিচার পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে তা নিয়ে। অতিরিক্ত একমত মানেই যে ভুল বিচার যুক্তিগত দিক থেকে তার ভিত্তি নাই যতক্ষণ না তা প্রমাণিত হয়। ফলে আপাত যৌক্তিকতার মধ্যেই জন্ম হয় অযৌক্তিক আচরণ। ঘটনার বর্ণনা আদতে কিছুই উৎপাদন করে না একটা বিভ্রম ছাড়া। তবে ঘটনার বর্ণনাকে আক্ষরিকভাবে না নিয়ে ভিন্নভাবে পাঠ করা যেতে পারে । মতামত, ভিন্নমত এসব থাকবেই। মার্কসের ভাষায় এই দ্বান্ধিকতাই সময়কে গতিশীল করে, সমাজব্যবস্থা নতুন রূপ পায় ।
মানুষের মধ্যে মতামতের ভিন্নতা স্বাভাবিক একটা বিষয়। ভিন্নমত গড়ে উঠে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থানগত কারণে, বেড়ে উঠার মধ্য দিয়ে, পড়াশুনা, জগৎকে বুঝে উঠার পার্থক্যের কারণে। কেউ নিজেকে সংস্কারে বন্দি করে, কেউ স্বাধীন চিন্তা দিয়ে আগল ভাঙ্গে। এখন দুই বা ততোধিকের মধ্যে যে সহমত গড়ে উঠবে না বিষয়টা এরকম নয়। ধর্মীয় ভাবাদর্শ কিংবা রাজনৈতিক আদর্শের জায়গায় সহমতীদের ব্যাপকমাত্রায় দেখা যায়, আবার এসবের বাইরে গিয়ে যৌক্তিক অবস্থানের কারণে সহমত তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়, তবে সর্বক্ষেত্রে এই সহমত বজায় থাকবে সেই আশাটাও বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।
. . .
Guilty or Not Guilty: The necessity of differs
(সহমত না ভিন্নমত : কোনটা কখন জরুরি)
মোরাদুল ইসলাম নামে যে-ভদ্রলোক উনার এফবি স্ট্যাটাসে পোস্টার হিসেবে এইটা দিছেন, কী উদ্দেশ্যে দিছেন জানি না, প্রথম পাঠের পর ডজ খাওয়ার সম্ভাবনা থাকতেছে এখানে। নেটে খোঁজ নিয়া দেখলাম এরকম একখানা আইন ইহুদি সমাজে ছিল বটে। তবে ভদ্রলোক যেভাবে দিছেন সেভাবে নয়। Reddit -এ সেইম টপিক নিয়া খুব ভালো ডিসকাশন পাবেন। লিংক দিয়া রাখলাম। সময়-সুযোগ করে দেখতে পারেন। দি হাদিস তালমুদ থেকে আসছিল। পরে যদিও হুবহু ওই বিধান অনুসরণ করা সম্ভব হয় নাই। শুনানি শেষে সকল বিচারক যদি একমত হইতেন আসামি নির্দোষ,- দুই থেকে তিন দিনের জন্য রায় তখন স্থগিত করা হইত। আসামি সত্যি নির্দোষ কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য উক্ত সময়সীমা বেঁধে দিতেন আদালত। বড়ো কথা, এইটা আমাদের হাদিসের মতোই ইহুদি হাদিস। আর এগুলা নিয়া রাব্বিদের মধ্যে মতভেদের অন্ত নাই। যে-কারণে Reddit -এ অনেকে যোগ করতেছেন দেখলাম,- হাদিসে থাকলেও ইহুদি জুরিসপ্রুডেন্সের ভিত্তিতে পরিচালিত আদালতে এইটাকে গুরুত্বহীন গণ্য করা হইত। করাটা স্বাভাবিক। কোনো অপরাধের ব্যাপারে সকল জুরির একমত হওয়া কঠিন। হইতে পারেন যদি মামলার ভিত্তি দুর্বল হয় অথবা যথেষ্ট প্রমণাদি শুনানির সময় হাজির করা সম্ভব না হয়।
তবে হ্যাঁ, লজিক্যাল ফ্যালাসি হিসেবে এইটা ইন্টারেস্টিং। কোনো বিষয়ে সবাই যদি দ্বিমত পোষণ করেন তাহলে ধইরা নিতে হবে গলতি থেকে যাইতেছে। এমন কোনো দিক থাকতেও পারে যা আমরা আসলে ভেবে দেখি নাই। সুতরাং আরো ডিপে গিয়া খতিয়ে দেখা ভালো। একইভাবে সবাই যদি একমত পোষণ করেন তাইলে ডাল মে কুচ কালা হ্যায় ধরে নেওয়াটা হইতেছে স্বাস্থ্যকর। সামাজিক প্রগতির এইটা বেসিক।
দেরিদা এ-কারণে ভাষার আচরণ নিয়া আলাপে রিডিং বিটুইন দ্য লাইন বা এম্পটি স্পেস -এর প্রসঙ্গটি তুলছিলেন। কোনো টেক্সট কখনো সম্পূর্ণ হইতে পারে না। সবসময় তার মধ্যে এমনসব উপাদান থেকে যায় যেগুলা এখন দেখা না গেলেও পরে নজরে আসে। বলতে পারেন, বব ডিলানের বহুশ্রুত গানের কলি The Times They Are A-Changin’-এর মতো দাঁড়াইতেছে বিষয়টা। কোরান -এর কথা ধরেন। আয়াতের-পর-আয়াতে জীবনচক্র বুঝাইতে বায়ুপ্রবাহ ও বৃষ্টির কথা আসছে। চৌদ্দশ বছর আগে এর অর্থ একভাবে মানুষ বুঝে নিছেন। পরবর্তী শত-শত বছর ধরে সময়ভেদে যে-যার মতো এসব আয়াতকে বোঝার চেষ্টা করছে। এখন এই আয়াতগুলাকে আমরা বিজ্ঞানের থিয়োরি দিয়া বোঝার চেষ্টা করতেছি। চেঞ্জটা কিন্তু মার্ক করা দরকার।
তুর্কে নিবাসী ক্যানার তাসলামান যেমন মনে করেন,- কোরানে সন্নিবেশিত সিম্পল আয়াতগুলা সিম্পল নয়, বরং বায়ু হইতে বৃষ্টিবাদলার পুরা সিনটা কেউ যদি ইমাজিন করে, বৈজ্ঞানিক পরিমাপক দিয়া মাপে তাহলে রীতিমতো জটিল ও অবিশ্বাস্য এক জগৎ তার সামনে হাজির হইতে বাধ্য। নিজের ধারণা বুঝাইতে গিয়া The Quran, Unchallengeable Miracle নামে আস্ত একখানা কিতাব নামাইছেন ভদ্রলোক। পড়তে কিন্তু মজা আছে বেশ।
এককালে ইরাননিবাসী ও ইসলামের নিবিড় অনুসারী আলী সিনা আবার কোরানকে প্রত্যাখ্যান করছেন। উনি নিজেকে আর মুসলমান বইলা ভাবেন না। মানে ইসলাম ত্যাগ করছেন আর কি! পিউ রিসার্চের জরিপ মোতাবেক প্রতি বছর যে-পরিমাণ লোক ইসলামে বয়েত নেয়, তার বিপরীতে গণ্য একখান অংশ ধর্মটি ত্যাগ করে হামেশা। আলী সিনা যেহেতু ত্যাগ করছেন, এইসব বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিবাদলা সংক্রান্ত আয়াতগুলাকে উনি মরুভূমির রুক্ষ জলবায়ুর জায়গা হইতে রিড করতেছেন। মোহাম্মদের দরকার ছিল আরব গোত্রকে খোদার মহিমা ও অলৌকিক শক্তির দিকে প্রলোভিত করা। সেজন্য জীবনচক্রের এই রিপিটেশন উনি আওরাইছে তখন। খোদার নামে চালাইয়া দিছে সব, যে-খোদা আসলে উনি নিজে ছাড়া অন্য কেউ না। মোহাম্মদের মনোজগৎ নিয়া আলী সিনার Islam Dismantled: The Mental Illness of Prophet Muhammad ইন্টারেস্টিং বই। যাই হোক, বেহেশতের বিবরণে নদী, জল আর ফলমূলের ছড়াছড়ির একশেষ একই কারণে ঘটছিল বইলা আলী সিনা উনার কিতাবে রায় ঠুকছেন। মরুবাসী আরবের জন্য এগুলা তো আসলেই বেহেশতি জেওর। আবার ধরেন, অজ্ঞেয়বাদী ইহুদি বিদূষী ল্যাজলি হ্যাজিলটন কোরানের বেহশতকে ইহজীবনের আরেকখানা উর্বর প্রতিরূপ হিসেব পাঠ করছেন। উনার মতে, এই বেহেশত মানবিক এবং অতিশয় ফ্যাকান্ড বা উর্বর। নবি মোহাম্মদকে নিয়া উনার দ্য ফার্স্ট মুসলিম বইটা পড়ে দেখতে পারেন। জোশ!
…
তো এসব হইতেছে এক ধরনের ওই রিডিং বিটুইন দ্য লাইন … যা ডিলানের The Times They Are A-Changin‘-এর মতো আমাদের মগজের কোষগুলাকে সময়ভেদে অন এবং অফ যাইতে কয়। ভিন্নমত এখানে ফলদায়ক, যার পটভূমি আপনি ভালোই তুলে ধরছেন। বেলাল ভাইয়ের শেয়ার দেওয়া পোস্টারের ইহুদি বিধান নিয়া ভাবতে গিয়া সিডনি লুমেটের 12 Angry Man ছবিখানা দিমাগে চট করে জ্বলে উঠল। প্রায় সত্তর বছর আগে হলিউডে তৈরি সিনেমাটার প্রাসঙ্গিকতা আজো অমলিন। প্রচুর লোকজন এখনো ছবিখানা দেখতেছেন। এর ফ্যাক্ট এবং যেভাবে পরিবেশনা করা হইছিল সেই কারণে ছবিটা আজো মানুষ দেখতেই আছেন।
কোর্টরুম ড্রামা, যেখানে আমরা দেখি আদালতে দীর্ঘ শুনানি শেষে ১৮ বছরের এক ছেলে তার মদ্যপ পিতাকে হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়। শুনানি শেষে আসামি অপরাধী এই ব্যাপারে ১২ জন বিচারকের মধ্যে ১১ জন একমত ছিলেন। একজনের মনে তখনো প্রশ্ন ছিল। খটকা দূর হইতেছিল না কোনোভাবে। এখন নিয়ম মাফিক রায় দেওয়া যাইতে পারত। কিন্তু উনারা সিদ্ধান্ত নিলেন, যিনি এখনো বলতেছেন আসামি তার পিতাকে হত্যা করে নাই, তো উনার এই আর্গুমেন্ট নিয়া আরেক রাউন্ড আলাপ করা যাইতে পারে। আলাপে বসে সকলে গেলেন ফেঁসে। পুরা রাত তর্ক-বিতর্ক হইতে ঝগড়াঝাটি সব চলছিল। এবং পরিশেষে দেখা গেল ওই একজনের আর্গুমেন্টকে বাকিরা ভ্যালিড ধরতে বাধ্য হইতেছেন ক্রমশ।
এই ছবি আমাদের শেখায়,- সন্দেহ ও প্রশ্ন কেন জরুরি। কেন জরুরি ক্রিটিক জারি রাখা। কেনইবা হাইডেগারকে উনার বিয়িং এন্ড টাইম গ্রন্থের সেকেন্ড পার্ট কেন আসতেছে না জিগাইলে দার্শনিকপ্রবর উত্তরে বলছিলেন,- আপনারা কখন বইটারে বাতিল করবেন তার অপেক্ষায় আছি। বাতিল না করলে দ্বিতীয় পার্ট লেখায় আগানো সম্ভব না।
…