বাংলাদেশের ইসলামকে আরবের ইসলাম বানানোর চেষ্টা করবেন না : ফরহাদ মজহার
ফরহাদ মজহারের হাত-পা বাঁধা। উনি যে রুহানিয়াতের বাংলাদেশ চাইতেছেন সেখানে ছাত্রশক্তি ও বর্তমান সরকার তাঁর অবলম্বন। অগতির গতি বলা যাইতে পারে। কোনো প্রকার বিপ্লবী শক্তি যদিও চব্বিশের গণআন্দোলনে সক্রিয় ছিল না। যারা ছিল সকলে কমবেশি সুবিধালোভী। হালুয়া-রুটির কারবার সারতে হাসিনাপতনে শরিক ছিল। জীবনের পুরোটা সময় বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর মজহার তথাপি ছাত্রশক্তিকে বিপ্লবী ন্যারেটিভে ধরতে চাইতেছেন। ৫ আগস্টের প্রহর থেকে ধরতেছেন। আখেরে এর জন্য তাঁকে হয়তো প্রতবিপ্লবের সম্মুখীন হইতে হবে। সেখান থেকে পালটা প্রতিবিপ্লবে যাওয়ার ঠেকা পড়বে তখন। ছাত্রশক্তিকে বাকিরা ততদিনে মাঠছাড়া করবে।
যাই হোক, রুহানিয়াতের বাংলাদেশ সফল হইলে তো ভালো, যদি না হয় তাতে ফরহাদ মজহারের গুরুত্ব কিছু কমে না। উনার মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত পড়তে বেশ ভালো। আটাত্তর বছর বয়সে সক্রিয় এই চিন্তককে দেখতে পারা মন্দ না। উনার মধ্যে স্বরোধিতার অন্ত নাই, তথাপি আমাদের দেশকালের নিরিখে মজহার নিজেকে এখনো প্রাসঙ্গিক রাখতে পারছেন। বুইড়া বয়সেও রাইসুদের তুলনায় তাঁকে বরং অধিক কোমল আর মানবিক দেখতেছি আমরা। দেশ জুড়ে মরমি ঘরানার ইসলামে বিশ্বাসীদের উপ্রে লাগাতার হামলার বিরুদ্ধে ফরহাদ মজহারের অবস্থানকে অ্যাপ্রিশিয়েট করা উচিত।
. . .
সাধারণ মানুষের ওপর জোর করে এলিয়েন কালচার চাপিয়ে দিলে পরিবর্তনের পথ দ্রুত বিপথে গমন করে। বিপথে গমনের হিসাব যদি মাথায় রাখি তাহলে ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে এক ধরনের সাংস্কৃতিক উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার মিশন অবাস্তব কিছু নয়। সেইসব দেশে এর সম্ভাবনা থাকছে যেখানে তার নিজস্ব সংস্কৃতি মৃতপ্রায়। হাজার-হাজার বছর ধরে বাংলাদেশে যে-সাংস্কৃতিক বনেদ গড়ে উঠেছিল, সেটি কি অতীতের মতো প্রাণবন্ত এখন? জাতি হিসেবে আমরা কি হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ধারণ করছি? আমার কাছে মনে হচ্ছে আমরা এক-এক অংশ এক-এক খণ্ডকে ধারণ করি, যার ফলে সর্বজনীন সংস্কৃতির রূপটা অতীতের মতো নয়।
প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে ইসলামকে অভিন্ন কাঠামো দান করার চেষ্টা চলছে। বাস্তবতা অবশ্য সেই চেষ্টার বিপরীত সাক্ষ্য আজো দিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক, আরব অঞ্চলের দেশগুলো, আফ্রিকার মুসলমান প্রধান দেশ, এবং পারস্য ও ভারতবর্ষে ইসলামের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা এখনো প্রবল। এখন এই ভিন্নতা আমাদের কাছে সুন্দর ও স্বাভাবিক মনে হয়। সংস্কৃতির স্বাভাবিক নিয়মে এসব সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশে যে-কারণে বিচিত্র ও ভিন্ন মত-পথের ইসলামি সংস্কৃতি চর্চায় আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। একে এখন জোর করে একটি চেহারা প্রদান কতটা যৌক্তিক?
এ-যুগের সাম্রাজ্যবাদী ইসলামি উগ্রপন্থার জন্য এটি হচ্ছে বড়ো জটিলতা। এই ইসলাম চায়,- বিশ্বের সকল মুসলমান আরব অঞ্চলে চর্চিত ইসলামকে কবুল করুক। উম্মাহ কেন্দ্রিক ইসলামি আন্দোলন, যাকে তারা খেলাফত নাম দিচ্ছেন, এখন এর প্রবক্তারা কি সত্যি বলতে ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী? নাকি ক্ষমতার জন্য ইসলামকে তারা হাতিয়ার করছেন?
মুসলমানদের মধ্যে আল্লাহ ও তার রসুলগণের প্রতি বিশ্বাস ও আমলের প্রশ্নে বড়ো মতভেদ নেই। আকিদা সকলের এক কিন্তু এর অনুশীলনে ভিন্নতা রয়েছে। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব ও এর সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে সফল ইসলামের বিচিত্র সাংস্কৃতিক রূপ হাজার বছর ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তে চর্চিত হচ্ছে। সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিনিময়ের প্রথাকে আমলে না নিয়ে আকিদার প্রশ্নটিকে খেলাফতওয়ালারা সামনে নিয়ে এসেছেন। এমনভাবে নিয়ে এসেছেন, শুনে মনে হবে,- কেবল উনারা সঠিক আর বাকিরা ভ্রান্ত। দল-উপদলে ভাগাভাগি ও কামড়া-কামড়ি সমগ্র মুসলিম বিশ্বে কমন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাফতের ছাতায় সবাইকে নিয়ে আসা গেলেই কি এসব মিটে যাবে? খেলাফতের কারণে ধর্মের প্রসার হয়তো দ্রুত ঘটবে, কিন্তু মূল লক্ষ্য থেকে সে আরো দূরে সরে যেতে থাকবে। এই হিসাবে প্রতিটি ধর্ম তার কোর ফিলোসফির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মারাত্মক সব ভুল পথে তারা গমন করেছে সবসময়। কেবল আমরা নই, প্রধান ধর্মগুলোর অনুসারীরা ইতিহাস থেকে কখনো শিক্ষা নেয়নি।
. . .
খিলাফতের এইটা লক্ষ্য হাসান;- একচ্ছত্রবাদ কায়েম করা। রাজা-রাজড়ার যুগে স্বাভাবিক ছিল। এখনো বিচিত্র ছদ্মবেশে চলতেছে। হাসিনা একচ্ছত্রবাদ কায়েম করেছিল। এরাও ইসলামের নামে সেদিকে হাঁটতে উতলা। আল্লা তাদের কানে মোহর মেরে দিছেন, সুতরাং কিছু শুনতে পারবে না।
পতুর্গিজ কবি ফার্নান্দো পেসোয়া তাঁর দ্য বুক অব ডিসকোয়েট বা অশান্ত কিতাব-এ এক রোমান সম্রাটের কথা ইয়াদ করছিলেন। সম্রাটের কোনো ফরমানে পর্ষদরা ব্যাকরণের ভুল ধরলে উনি থেপে লাল হইতেন। যে-বান্দায় ভুলটা ধরছে তারে ঝাড়ি দিয়া সবক দিতেন সম্রাট, তারে বলতেন,- ভুলে যাও কেন, আমি হইতেছি রোমের সম্রাট। সকল ব্যাকরণের ঊর্ধ্বে আমার স্থান। পেসোয়া এর নাম দিছিলেন সুপারগ্রামাটিকাম (Supergrammaticam)। এখন ব্যাকরণের কাছে দাসখত লিখে অনুভূতি প্রকাশ আত্মহত্যার নামান্তর। ব্যাকরণ তো আসলে পদ্ধতি, এবং সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনযোগ্য। কোনো আইন বা অকাট্য নিয়মে তারে পরিণত করা ঠিক না। কথাখান আমরা যত সত্বর বুঝব, ততই মঙ্গল। দুনিয়া বৈচিত্র্যে মনোহর। ইসলামও তাই।
. . .
আমরা কীভাবে বুঝব! আমাদের মন বড়ো রঙিন! আমরা সবকিছু নিজের মতো করে পেতে চাই। আমরা চাই এদেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হোক, আবার এটাও চাই,- প্রতিবেশী দেশটি চমৎকারভাবে সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত হোক।
. . .
খেলা এখানেই হাসান। নিজের বেলায় খিলাফাত আর পরের বেলায় সেকুলার;- অবস্থানটা স্ট্র্যাটেজিক। ফর এগজাম্পল, হিযবুত তাহরীরের কথাই ধরেন। তারা খোয়াব দেখে সারা বিশ্বে ইসলামি খেলাফত কায়েম করবে। যতদিন কায়েম না হইতেছে তাগো ভিশন মোতাবেক অমুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলাকে তারা দারুল কুফুর গণ্য করতে থাকবে। মুসলমান ভাইবেরাদার থাকলেও রাষ্ট্রগুলা কুফরিতে সয়লাব, সুতরাং মুসলমানের বসবাস উপযোগী নয়। তার মধ্যে যেসব রাষ্ট্র সেকুলার সেগুলাকে স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট অব ভিউ থেকে আপাতত মন্দের ভালো ধরবে হিযবুত। আর কিছু না হউক, সেকুলার ও গণতান্ত্রিক থাকায় মুসলমানের সেখানে সুরক্ষিত থাকার চান্স বেশি। জিহাদের মাধ্যমে দেশ দখল ও মুসলমান কওমকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত কাজেই সেকুলারিজমকে কৌশলগত প্রশ্নে হিযবুত এলাউ করবে। এসব কার্যকারণ আমরা স্বীকার করি বা না-করি, তার ভিশন সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ।
. . .
তার মানে দাঁড়ালো, ধর্মীয় যে-কোনো গোষ্ঠী তার জন্য উপযুক্ত সময়-সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। বাংলাদেশে এখন সেই সময় এসে গিয়েছে। এনজিওগ্রাম সরকার যেহেতু মৌলবাদকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছেন, সেহেতু এটাই মোক্ষম সময় ধরে নিয়ে দেশে ইসলামিকরণের তোড়েজোড় শুরু করেছে উনারা। নীতি-নৈতিকতা বা বিবেচনার বালাই থাকছে না সেখানে। যা মন চায় করছেন। প্রশ্ন হলো,- উনারা যা করছে, তার দায় কে নেবে এখন?
দুঃখের বিষয় হচ্ছে বিগত ৫৩ বছরেও জাতিগতভাবে কোনো দার্শনিক অবস্থানে আমরা স্থির হতে পারিনি। তার মধ্যে আবার ধর্মকে ঢুকিয়ে সব জগাখিচুড়ি করে ফেলেছি। এর দায় আমাদের মতো সাধারণ জনগণ এড়াতে পারে না। গলা তুলে আমরা কখনো কথা বলিনি। নিজের ভয়েজ রেইজ করতে পারিনি। প্রেশার গ্রুপ হিসেবে সমাজে নিজের অবস্থান তৈরিতেও ব্যর্থ হয়েছি। ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারিনি। এই সুযোগে রাষ্ট্রক্ষমতায় স্বৈরাচার বারবার দেখা দিয়েছে।
সেকুলারিজম হয়তো সঠিক সমাধান নয়, কিন্তু এর উত্তম বিকল্প কি আমরা তৈরি করেছি? বিকল্প কিছু তো বের করতে পারিনি এখনো! সেকুলারিজম নিয়ে বিবাদ থাকলেও এর চর্চা যদি সমাজে থাকত তাহলে বিচিত্র মত-পথের সহাবস্থান ঘটানোর রাস্তাটি হয়তো আমরা খুঁজে পেতাম। রুহানিয়াত আর ইনসানিয়াতের বাহানায় দেশে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার মিশনকে প্রতিহত করার মতো শক্ত ন্যারেটিভ তখন আমাদের হাতে মজুদ থাকত।
. . .
জটিল প্রশ্ন হাসান! দায় সকলকে কমবেশি নিতে হবে। আওয়ামী লীগকে প্রশ্নাতীতভাবে নিতে হবে, কারণ তাদের তরিকা আগাগোড়া ভুলে ভরা ও স্বার্থান্ধ ছিল। বিএনপিকে নিতে হবে। সুশীল সমাজকে তো অবশ্যই নিতে হবে। কবি-লেখকদেরকে নিতে হবে সব থেকে বেশি। আওয়ামী লীগ প্রযোজিত একচ্ছত্রবাদের প্রতিবাদে নামতে তারা ভয় পেয়েছেন। উল্টো সুবিধা নিয়েছেন বিস্তর। সর্বনাশ যখন ঘটছে,- তারা গা করেননি। নতুন পরিস্থিতি থেকে কীভাবে মেওয়া তুলে নেওয়া যায় তার হিসাব করছিলেন সবাই।
সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও পরে আনন্দ বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীকে নিয়ে নানা গল্প আছে। এর একটি হচ্ছে, সম্পাদক ও সাংবাদিক হিসেবে প্রচণ্ড আত্মমর্যাদা বজায় রেখে চলতেন। গোলাম মাওলা রনির কথা সত্যি নাকি মিথ্যা জানি না, তবে তাঁর এক পডকাস্টে শাহাদত চৌধুরী প্রসঙ্গটি খানিক ছুঁয়ে গেছে উনি। রনির মতে, শাহাদত চৌধুরী এমন এক বান্দা ছিলেন যিনি খোদ প্রেসিডেন্ট এরশাদকেও ভয় পেতেন না। জাদরেল সামরিক শাসককে নিজের টেবিলে পড়ে থাকা পেপার ওয়েটের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতেন না শাহাদত।
রনির গল্পটি সত্যি হতেও পারে, মিথ্যা হওয়াটা আবার অবান্তর নয়;- তবে উনার বলা শাহাদত চৌধুরীর কাহিনিটি শিক্ষনীয়। সমাজে মেরুদণ্ড সটান রেখে কীভাবে চলতে হয় সেই ম্যাসেজটি আমরা এখান থেকে পাচ্ছি। দেশ এখন মেরুদণ্ডহীন মানুষে সয়লাব হয়ে গেছে। শঙ্খ ঘোষের হামাগুঁড়ি কবিতার চরণ যেন-বা সকলকে তাড়া করছে সবিরাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে তারা প্রশ্নটি করছেন হয়তো-বা, কবি যেমন করেছিলেন একদিন : -‘কি খুঁজছেন?’/ মিহি স্বরে বললেন তিনি: /-‘মেরুদণ্ডখানা।’
. . .
সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪ ঈসায়ী সনের দিবাগত রাতে চলমান নেটালাপের প্রক্ষিপ্ত অংশগুলো আমরা এখানে বাদ দিয়েছি। জাভেদসহ আলাপিরা মন্তব্য যোগ করেছিলেন সেখানে। মূল আলাপ সেগুলো কাভার করায় পুনরাবৃত্তি সমীচীন নয় বলেই মনে করছে থার্ড লেন। আলাপটি অতঃপর একচ্ছত্রবাদ ও রিভার্স ইফেক্ট শিরোনামে অন্য পরিসরে গমন করে এবং ক্রমশ একটি রচনায় পরিণত হয়। রচনাটি পাঠ করতে আগ্রহী পাঠক লিংক চাপতে পারেন।
. . .